পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১০

বিশ্বাস

তার সাথে দেখা হয় বাসে, ভীড়ে, নানা অনুষ্ঠানে।

প্রতিবেশী ভদ্রলোক ফর্সা, একটু মেদ আছে, গোলগাল চেহারার সাথে মাথার টাক মানিয়ে গেছে বেশ। সবসময় বোধহয় একটু ঘামেন। কথা হয় কদাচিত্। হলেও কেমন আছেন,ভালো আছি- এই জাতীয়। কিংবা বাজারে আগুন, দেশের যে কী হবে, ছেলে মেয়েগুলোর পড়াশোনায় মন নেই, না মশাই, আপনি জানেন না, আসলে ঘটনা হচ্ছে এই... ইত্যাদি, যেটুকু সময় লাগে এইসব বলতে, কখনও দেখা হয়ে গেলে, ভীড়ের বাসে ঝুলতে ঝুলতে, শেয়ারের রিকশায় বসে কিংবা কারো বাচ্চার জন্মদিনের কেক কাটার ফাঁকে কোনো কথা না খুঁজে পেয়ে।

সেদিন দুপুরে ভাত খেয়ে গা এলিয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছি এইসময় আমার স্ত্রী বলল, শুনেছো, সালাম সাহেব কেমন মানুষ বলত, সংসারে মন নাই নাকি!

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০১০

রূপকথার পালক ও কয়েকটি গদ্যকবিতা

সময়কে ছেড়ে দিলে

একটি পরিবার। একটি মহল্লা। একটি শহর। দানা বেধে দিনাতিপাত। প্রজন্ম থেকে জন্মায় নতুন প্রজন্ম। কাঁধ বদল হয় জীবনের বোঝা। ঘুরে ফিরে আসে দ্বেষ, সংশয়, সহমর্মিতা। কোথায়ো জোট বাধে মানুষ, কোথায়ো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জটলা। যখন ভাঙ্গনের গান শুনে আসে বিচ্ছেদ, ফুলেরা কাঁদে, কাঁদে বসন্তের হাওয়া। চায়ের দোকানে ঘাঁটি গাড়ে অবেলার রোদ।

আমি আর নীলাঞ্জন

একদিন এক ময়ূরাক্ষী মেয়েকে বললাম
পিয়ারী, তোমাকে ভালবাসি। ভালবাসি তোমার হাসি, কটাক্ষ আর ছলনা।
থুতনিতে তোমার একটি হাত, কপালের চুল সরাতে ব্যস্ত তোমার একটি আঙুল
ভালবাসি তোমার নিরবতা, কিংবা মুখরতা, যাই হোক।

সে মেয়েকে খেয়ে নিল সমাজের বাঘ
প্রশ্ন করলে বলল, চুপ কর হারামজাদা, তোদের পিয়ারী থাকতে নেই।

একদিন নদীকে বললাম

যত সংকট সিংহপুরে

১.
সিঙ্গাপুরে এসে প্রথম প্রথম যা দেখতাম তাই ভালো লাগত। মুখর বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন দেশ পরিবেশ, বিভিন্ন ভাষা দেশ সমাজের মানুষ। সমস্যা একটাই, খাবার। এমন বিচ্ছিরি বদখত গন্ধ একেক খাবারের, খাই কীভাবে!

বেশ কয়েকজন সহপাঠি এসেছিলাম একসাথে। তাদের একজন শুভ্র, যা খায় তাই ভাল লাগে তার। প্রতিদিন একত্রে খেতে বসি আর যত গালি জানি খাবারের সাথে শুভ্রর গায়ে উগড়ে দেই। এদিকে ব্যাটা তারিয়ে তারিয়ে মালে, ইন্দোনেশিয়ান, চায়নিজ, জাপানিজ, ওয়েষ্টার্ণ আবজাব খায় আর বদন কেলিয়ে হাসে।

বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১০

প্রকৃতির ঈশ্বর

"The best way to predict the future is to invent it" - থিওডর হুক 
 
এত কিছু থাকতে ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়লাম কেন? পড়লাম কারণ, সেটাই তো আমাদের টেস্টিং গ্রাউন্ড। কে সঠিক আর কে ভুল, কে অস্ত্বিত্বহীন আর কে নিয়ন্তা, কে টেকসই আর কে ফুটোকড়ি – ভবিষ্যতই তো আমাদের বলতে পারে। অতীতকে নানাভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু এক্সট্রাপোলেশন করে সঠিক আন্দাজ কয়জনই বা করতে পারে?

ঈশ্বরের প্রকৃতি

ঈশ্বরের পৃথিবী হচ্ছে 'ফ্ল্যাট ওয়ার্ল্ড' - পুরাই সমতল পৃথিবী, এর উপর সবাই সমান, অন্তত সে রকমই শেখানো হয়েছে আমাদের। ঈশ্বরই নাকি সবকিছুর নিয়ন্তা। তাহলে তিনি নিশ্চই চাইবেন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলুক। কিন্তু জগতে কত কিছুই না আছে - অস্বাভাবিক, অকল্পনীয়, ক্রুঢ়। কেন জগতের সবাই একই প্রিভিলেজ নিয়ে জন্মায় না? কেন কেউ কেউ সুস্থ হয়ে জন্মাবে আবার কেউ জন্মান্ধ হবে? কার দোষে কোনো কোনো হতভাগ্য মানুষ কখনই জানতে পারবে না - শিশুর হাসি কতটা নির্মল, আকাশ কতটা নীল, জোছনা কতটা মায়াময়, কতটা সুন্দর প্রেমিকার গালের ছোট্ট তিল! কেন নিজের সৃষ্টিকে ঈশ্বর জন্মান্ধ করে জগতে পাঠাবেন? কেন নিষ্পাপ শিশুকে বঞ্চিত করবেন স্নেহ-মায়া-মমতা থেকে? কেন তাকে ভোগাবেন রোগে-শোকে-তাপে?

এই সব ভাবায়।

বুধবার, ২০ অক্টোবর, ২০১০

কচ্ছপ দ্বীপ

এত ব্যস্ততা যাচ্ছিলো যে হাঁপ ছাড়ার সুযোগই পাচ্ছিলাম না। যখন সুযোগ মিললো তখন দেখি হাঁপ ছাড়ার সুবিধামতন কোনো জায়গা পাই না। এদিকে সিঙ্গাপুরে বৃষ্টিপাত একটু কমলে পর আবহাওয়াটাও ভালো হতে শুরু করেছে তা প্রায় সপ্তাহখানেক। মোটের উপর তাই কোথাও ঘুরে আসার ইচ্ছাটা মনে চাগার দিয়ে উঠলো।
ঠিক হলো রবিবারে কুসু আইল্যান্ডে গিয়ে সমুদ্রস্নান হবে।

অনেকদিন কোনো নড়াচড়া হয় নাই। নদী, সাগর, পর্বতমালা দূরে থাক বাড়ির পাশের ঝোপে বৈকালিক রোদের আড়ালে কি কি হয় তাও দেখার অবসর ছিল না। তাই ভাবলাম, এখন যখন ফুরসত মিলেছে তখন প্ল্যান প্রোগ্রাম করে আগানো যাক। কিন্তু গভীর রাত অবধি প্রোগ্রামের প্ল্যান করে আর চোরাই ওয়েবসাইটে আই এম লিজেন্ড দেখতে গিয়ে ছোট্ট ভজঘট লেগে গেলো। সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দেখি- আমরা অলরেডি বেহাইন্ড দ্য স্কেজুল।

হাউজ দ্যাট!

সকালের মেঘাচ্ছন্ন মাঠ আর কর্দমাক্ত আকাশ। এরকম কঠিন পরিস্থিতিতে নটআউট থাকা সহজ কথা না। সেট হয়েও কত ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যায়! কিন্তু তাকে আউট করা যাচ্ছে না। একেবারে ঘাম ছুটিয়ে ছাড়ছে বলা যায়।

লাঞ্চে গেলেন নটআউট অবস্থায়।

এদিকে ক্যাপ্টেনের চিন্তিত মুখ, কপালের পাশে ঘামের চিকন রেখা। এর ওর কাছ থেকে টিপস নিচ্ছেন কীভাবে এই শক্ত লাইনআপকে লুজ মোশনের মত ঝেড়ে ফেলা যায়। বারবার পজিশন বদলেছেন, বিভিন্নভাবে কয়েকবার চাপ সৃষ্টি করেছেন- কিন্তু যে লাউ সেই কদু। ফাস্ট, স্পিন, মিডিয়াম, স্লো, রাউন্ড দ্য উইকেট, কোনোটাতেই কাজ হচ্ছে না।

কাতারের ডায়েরী

১.
ঠিক এক বছর পর আবার কাতার আসতে হলো
প্রজেক্টের কাজে গতবছর এই সময়েই দু'মাস কাতার থাকতে হয়েছিলসে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতাপণ করেছিলাম, যেখানে রোদের তাপে খেজুর গাছের পাতাও পুড়ে খাঁ খাঁ, সেই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে আর আসবো নাঅন্ততঃপক্ষে গ্রীষ্মে (মে- আগস্ট) তো নয়ই
'পণভাঙ্গা পরিস্থিতি' বলে একটা কথা আছেএর সংজ্ঞা হলো, যে পরিস্থিতিতে শুধু মন্দ-কপালের মানুষেরা মাঝে মাঝে নিপতিত হয়এমনই এক অবস্থার শিকার হয়ে পণ ভেঙ্গে আবার আসলাম শেখের শেখ কাতারীদের দেশে

কী কারণ অনুভবে?

কেন প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে প্রেমিকের মনে হয়ঃ এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে’? কেনই বা আমাদের জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ’? কেন আম খেতে মিষ্টি লাগে? কেন মানুষ সঙ্গমে তৃপ্ত আর প্রত্যাখ্যানে ক্ষুব্ধ হয়? মানুষ কেন রেগে যায়? মানুষের সৌন্দর্যের, ভালো লাগার, ব্যথার, বেদনার, সুখের, ভয়ের- এইসব নানান অনুভূতিগুলোর উৎস আসলে কোথায়? 
 
আমরা সবাই আমাদের চারপাশের জগতকে দেখি, তার ঘ্রাণ শুঁকি, তার আওয়াজ শুনি, তাকে স্পর্শ করে ধন্য হই আর আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যেমনটা করেছেন হুমায়ুন আজাদ আমার ইন্দ্রিয়গুলিলিখে। আমরা ভাবতে ভালবাসি- আমাদের মানস পটে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বের যে ছবি আঁকা আছে সেটাই সত্যিকারের বাস্তব জগত।
আদৌ কি তাই?

জয়শ্রীর বাড়ি

তোমার বাড়ি আমাকে বারবার টানে নতুন গন্ধ হয়ে
জয়শ্রী যেখানে শোয়, চুল শুকায়, গুন গুন করে নায়
আমি তার উঠোনে পৌঁছুলে দুপুরের ছায়া গাঢ় হয়
একটা শালিক শুধু লেবুর ঘ্রাণ বেয়ে উড়ে আসে ভুলে ।
 
যে কারণে কারো কারো মনে যৌবন ফিরে আসে
জমাট বুকের ভেতর জমা আদর পেয়ে ঘুমায় পাথর
বেঁচে থাকা তাই শুধু জয়শ্রীর বাড়ি, তোমার আলতা
ভেজা আঙিনায় টহল দেয় না কোনো সভ্যতার জীবাণু ।
 
এইসব শুনে জয়শ্রী হাসে, তার ভ্রূ নাচে আর খুলে যায় খোঁপা
আর আমি, ফিরতে গিয়েও ফেরা হয় না আর ।

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১০

অক্টোবর

এখনও কি জোয়ার আসে অক্টোবরে,
হরিণের চোখে কাজলেরা গাঢ় হয়, রাতের ছায়ার মত নৈঃশব্দ
তোমাকে গ্রাস করে, নারী।

লুটেরা জোৎস্নায় বিধ্বস্থ আমার ঘর, লন্ঠনের আলো,
বাইরের হাজারটা নিয়ন।
আমি জানি না এখন কী কাটালের কাল, কোন বছর, কী ঋতু
পৃথিবী কতবার প্রদক্ষিণ করল সূর্যকে
কতটা গলেছে উত্তর মেরু।
রাতের ছায়ায় তন্দ্রাবতী শালুকের দল কেন জলের দিকে
কিংবা সহস্র তারামন্ডিত আকাশ কেন মাটির দিকে
ধাবিত হয়
কেন আসে না ফিরে সেই অক্টোবর

শহরকে অচেনা মনে হয়।

পোলারয়েড

রিকশার টুংটাং শব্দ গলিয়ে দিয়ে যায় শহরের কঠিন হৃদয়। ঘর্মাক্ত ওভারব্রীজে হঠাৎ বাতাসে বিদ্রোহী হয় একটা হলুদ ব্যানার, ফুটপাতে নেমে নাচতে থাকে দেয়ালের কালো কালো অক্ষরগুলো। মাথার উপরে সূর্য দ্রুত লজ্জা ঢাকে মেঘের আঁচলে। দিনে দুপুরে আলোর অন্ধকারে খসে পড়ে একটা ছুটন্ত তারা, পৃথিবী রোদচশমা চোখে দেখে লাল গ্রহ, শনির বলয় তার রং বদলায়। বকুল ফুলের মত মুহূর্তে ঝরে পড়ে বাঁচার আকুল চেষ্ঠা, জীবিকার সঞ্চয়। একটা ঝিনুক পেটের টিউমারে যোগ করে আরেকটা বালিকণা, একটা রেণু খুঁজে পায় অন্য পরাগ। ছেলেটা বুকে শিশির নিয়ে মেয়ের হাতে তুলে দেয় একটা ন্যাতানো গোলাপ, মেয়েটার গালে জমাট বাঁধে গোধূলির মেঘ, কৃষ্ণচূড়ার দল, আর ডালিমের রং।

বিধাতা এদের ভাগ্যে কি রেখেছেন তা জানতে শহরের মাথার উপর দিয়ে সহসা পরীর মত উড়ে যায় একটি ছোট্ট তোতাপাখি।

প্রত্যাখান

ফরিদার আত্মহত্যার খবরে আমার ঘুম ভাঙ্গে আজ ভোরে।

ফরিদা আর আমি একই পাড়ায় থাকি, সেই হিসেবে আমি ওকে চিনি ছোটোবেলা থেকেই। আমাদের বাড়ির সামনে উঁচু বড় রাস্তা, সেটা পাড় হয়ে আবার নেমে গেলেই কালামদের বাঁশঝাড়, মোস্তফাদের পুকুর, তার পরপরই ফরিদার বাপচাচার ভিটা। ওদের বাড়ির সামনে ঈদগা মাঠেই ওর সাথে আমার প্রথম পুতুল খেলা।

ফরিদা আমার বছর দুয়েকের ছোট হবে, মানে বেঁচে থাকলে সবসময় তাই হত। পুতুলখেলা ছেলেদের খেলা নয়- এটা জানার আগে ফরিদাই ছিল আমার খেলার সঙ্গী। এরপর আর কোনোদিন আমার ফরিদার সঙ্গে ঘর করা হয়নি।

চক্র

মানুষের জীবন কী কেবলই একটা দীর্ঘ সরলরেখা, নাকি অনেকগুলো চক্রের সমাহার?

অফিস থেকে ফিরে কাপড় না বদলিয়েই বারান্দায় চেয়ারটা টেনে নিয়ে এতদিন লুকিয়ে রাখা বেনসনে তীব্র একটা টান দিতে দিতে রফিক এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজছিল।

মাঝে মাঝে মনে হয় প্রতিটা দিনই এক একটা চক্র, ভোর ছ'টায় উঠে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসা, তারপর নিজের চাকরি, মিটিং, এই ফাইল থেকে সেই ফাইল, লাঞ্চ, আবার মিটিং, ফাইল থেকে ফাইল, ভেন্ডিং মেশিনের কফিতে এক্সট্রা সুগার এক্সট্রা ক্রীম, আবার ফাইল, এরপর একসময় ছ'টা বাজলে বাড়ি ফেরা, বাচ্চাকে পড়ানো, ডিনার, টিভি, ঘুম, তারপর আবার ভোর ছ'টা, জীবনকে গোলকের গায়ে হেটে বেড়ানো পিপড়ার মত মনে হয় রফিকের।

এক রাতের গল্প

১.
-তুই কই?
মোবাইলে কেউ প্রশ্ন করলে আমি কখনো উত্তর দেইনা। বদলে আমি বলি, 'আপনি ভাল আছেন?'
-ব্যাটা ফাইজলামি করস? হালারপুত, আমি টিটু। কই তুই?
আবার প্রশ্ন। আমি বিগলিত গলায় বলি,
-আসসালামুআলাইকুম। কেমন আছেন টিটু ভাই?
-হারামি, আমার মোবাইলে বেশী ট্যাকা নাই, ফাইজালামি করিস না, হীরা। তোর জন্য ব্যাটা রইদে দাড়াইয়া আছি পাক্কা বিশ মিনিট। আইবি না?
'গু খা ' বলে আমি লাইন কেটে দেই।

কালকে নিয়াজের জন্মদিন। আজ রাতে এই উপলক্ষে পার্টি। রাত বারোটায়, নিয়াজের মেসে।
আমার আর টিটুর উপর দায়িত্ব দুই বোতল মাল কেনার। এক বোতল কেরু আর এক বোতল বিদেশী, যেটা পাওয়া যায়।

টিটুর এসএমএস আসে- 'আমি গ্যালাক্সির সামনে। কাম কুইক।'