পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১০

এক রাতের গল্প

১.
-তুই কই?
মোবাইলে কেউ প্রশ্ন করলে আমি কখনো উত্তর দেইনা। বদলে আমি বলি, 'আপনি ভাল আছেন?'
-ব্যাটা ফাইজলামি করস? হালারপুত, আমি টিটু। কই তুই?
আবার প্রশ্ন। আমি বিগলিত গলায় বলি,
-আসসালামুআলাইকুম। কেমন আছেন টিটু ভাই?
-হারামি, আমার মোবাইলে বেশী ট্যাকা নাই, ফাইজালামি করিস না, হীরা। তোর জন্য ব্যাটা রইদে দাড়াইয়া আছি পাক্কা বিশ মিনিট। আইবি না?
'গু খা ' বলে আমি লাইন কেটে দেই।

কালকে নিয়াজের জন্মদিন। আজ রাতে এই উপলক্ষে পার্টি। রাত বারোটায়, নিয়াজের মেসে।
আমার আর টিটুর উপর দায়িত্ব দুই বোতল মাল কেনার। এক বোতল কেরু আর এক বোতল বিদেশী, যেটা পাওয়া যায়।

টিটুর এসএমএস আসে- 'আমি গ্যালাক্সির সামনে। কাম কুইক।'
দূর থেকে টিটুকে দেখে মায়া হয়। বেচারা সত্যি সত্যি এই দুপুরের রোদে দাড়িয়ে আছে। এত তাড়াতাড়ি বের হবার প্ল্যান করা ঠিক হয়নি।
আমি রিকসা ছেড়ে দিয়ে টিটুর কাছে যাই। আমাকে দেখে টিটু বোধহয় স্বস্তিবোধ করে। বলে, কিরে হালা, এতক্ষণ লাগে আসতে?
আমি শুধু বলি, চল্।
দুজনে সিড়ি বেয়ে উঠে হোটেলে ঢুকি।
কিছুক্ষণ পর আমাদেরকে আবার রিকশা নিতে হয়। কেরু পাওয়া যায়নি। এরা নাকি বাংলা মদ বিক্রি করে না।
আবার রোদ।
গ্রীনরোডের দোকান বন্ধ। এক বোতলে এতগুলা পোলাপানের হবে না।তখনই আরেকটা বিদেশী কিনলে ভাল হতো।
মগবাজারের দোকানটাও দোতলায়। সিড়িতে সিগারেটের তীব্র গন্ধ। মদের দোকানে সিগারেটের গন্ধ কেমন বেমানান মনে হয় আমার কাছে। মদের দোকানে থাকবে মদের গন্ধ। ভুড়ভুড়ে নয়,এলকোহলের মিষ্টি গন্ধ। আমি সিগারেট খাই না। বমি আসে। একারনেই হয়তোবা আমার ভাল লাগে না।
যে লোকটা দোকানে ছিল সে বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমার হাতে হ্যাভারসেক। ভেতরে অন্য দোকানের মাল। লোকটা গন্ধ পেয়ে গেছে নাকি।
এখানেও কেরু নেই। রাম পাওয়া গেল। ফালতু জিনিস। তবে বোতলটা সুন্দর। কিনে ব্যাগে ভরার সময় দুই বোতলে ঠোক্কর খাওয়ার শব্দ হলো। লোকটার চোখে চোখ পড়তেই দেখি সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। থাক ব্যাটা। কার কি।
জিগাতলা ফিরতে ফিরতে সন্ধা। চারদিকে অন্ধকার। কারেন্ট চলে গেছে।
হাতড়ে হাতড়ে সিড়ি বেয়ে মেসবাড়িটার ছয়তলায় উঠা। এই তলায় এখনও কাজ চলছে। একটাই ঘর। বাকী অংশে নতুন ছাদ উঠছে। বাঁশ, কাঠ, ইট বালুর স্তুপ। হিসু পেলে এখানেই ছেড়ে দেয়া। সুব্যবস্থাই বলা যায়। ঝামেলা কম। আর অন্যটার জন্য পাঁচতলার বাথরুম। গোসলের জন্যও তাই।
খাবার নিচ থেকে আসে।
মোমবাতির আলোতে কটা মুখ দেখা যায়, বাকীগুলো জলন্ত সিগারেটের আড়ালে পড়ে থাকে।
মেঝেতে মোমটা ঘিরে অমল, বশির, হাদু আর সুমনের হাতে তাস।
নিয়াজ, রনি আর কমল চৌকিতে শুয়ে বসা। ওখানে কোনায় কিছুটা জমাট বাধা আঁধার।
পাশে চার বোতল স্প্রাইটের বোতল, কয়েকটা গ্লাস, আর পলিথিন ব্যাগে হয়তো চানাচুড়। সেরকমই কথা ছিল।
সবাই আমাদের ঢুকতে দেখে ঘুরে তাকায়। ব্যাগটা খালি চেয়ারটায় রাখতেই এক হাতে তাস নিয়ে সাধু ডান পা দোলাতে দোলাতে আমাদের দিকে চেয়ে বলে উঠে, খবর খারাপ রে। কালকে তুলির বিয়া।
চট করে নিয়াজের মুখের দিকে তাকাই। ঘরের কোনায় জমে থাকা অন্ধকার এখন নিয়াজের মুখ ঢেকে রাখে।

২.
ঘটনা আসলেই খারাপ। সাধুর কথায় যা জানা গেল তা হচ্ছে, তুলির বড় ভাই সৌদিআরব থেকে কয়েকদিন আগে এসেছে। তার আসার সেকেন্ডারি উদ্দেশ্য যাই হোক, প্রাইমারি উদ্দেশ্য হচ্ছে ছোটবোনের বিয়ে দেয়া। খালি বোনের বিয়ে উপলক্ষে কেউ বিদেশ থেকে ছুটে আসে না। তুলির ভাই এসেছে কারন, পাত্র নিজেও সৌদিআরব নিবাসী এবং তার বিশেষ বন্ধু। পাত্রের বাংলাদেশ ভ্রমনের একটাই উদ্দেশ্য - বিয়ে করা। আর তুলির বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্য বিয়েটা তার বোনের সাথে দেয়া। কথা পাকাপাকি সে দেশে ফিরে আসার আগেই সেরে এসেছে, এখন খালি কালেমা পড়ানো বাকী। এবং সেই কাজটা কালকেই ঘটানো হবে। অতি গোপন সূত্রে জানা খবর।
-এইটা একটা কথা তুই বল্! ট্রাম।
ভাবিষ্ট্ রনি কোনো একজনের টেক্কার উপর ট্রাম্প করতে করতে বলে।
নিয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
টিটোর বোধহয় মেজাজ খারাপ হয়। ধুর বলে চৌকির খালি জায়গাটায় শুয়ে পড়ে। আমি ওর মেজাজ খারাপের কারনটা বুঝে ফেলি। আজকের রাতের মজাটা গেল। এত কষ্ট করে জোগাড় করা মাল খাওয়া চাংগে। মাল খাওয়ার জন্য দরকার ফুরফুরে মন। অথচ ব্ন্ধুর মহাসমস্যা। তার নায়িকার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাচ্ছে চব্বিশ ঘন্টা পর। এই সময়ে ফুরফুরে ফুর্তি করা যায় না।
তাও আবার যার প্রব্লেম তার ঘরে, যার নিজের জন্মদিনে ডারলিং আরেকজনের বউ হবে তারই সাথে বসে।
ওরা আবার তাস খেলায় মন দেয়।
সুনসান। সুনসান।
আমি বাইরে বের হই। বালুর ডিবিটার একপাশ ভিজিয়ে তারপর পাশের সদ্য ঢালাই করা পিলারটার গায়ে হেলান দিয়ে সারাদিনের কথা ভাবতে থাকি।
কিছুক্ষন পর কমল আসে। সেও বালুর ডিবিটার শীর্ষ আন্দাজ করে তার জলকামান ছুঁড়ে দেয়। তারপর চেন টানতে টানতে বলে, কি করা যায় বলতো।
আমি কিছু বলি না। মদের দোকানের লোকটার কথা ভাবি। কেমন তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। এ কিসের লক্ষন কে জানে।
আমার সাড়া না পেয়ে কমল বলে চলে, ব্যাটা এইজন্যেই বলি ঐসব ফালতু কাজে জড়াইস না। শুধু শুধু। দুইদিন পিতলা পিরিত,আবডুম বাগডুম, চড়ুই পাখির ড্যান্স, তারপর মালদার পার্টি একটা পাইলেই লগে লগে ফুরুত। শালা নিয়াজ, মালের বোতল কোলে নিয়া এখন কান্দো!
অন্ধকারে কমলের মুখ দেখা যায় না। কথা শেষে থু দিয়ে কমল থুথু ফেলে বালির ঢিবির উপর।
আর তখনি কারেন্ট চলে আসে।
মোমবাতিটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। হাদু ফু দিয়ে নিভিয়ে দেয়। তারপর মোমটা হাতে নিয়ে বলে, রাত বারোটায় তোমাকে আবার জ্বালাবো সুন্দরী।
অমল বলে, গুরু মোম কিন্তু এই একটাই। আবার বাতি গেলেগা এইটাই ভরসা। নিয়াইজ্জারে ফুও দেয়াইতে হইবো এইটাতে। কিরে নিয়াইজ্জা ফু দিবি না?
অমল হ্য়তো ভুলে গেছে, এখনকার মূল বিষয় আর নিয়াজের জন্মদিন নয়, তুলির বিয়ে।
বশির তাস গুটায়। কারেন্ট আসার পর সবাই হাতের তাস ফেলে দিয়ে নড়েচড়ে ওঠেছে। খেলায় কারো মন নেই। সুমন ওঠে একটা স্প্রাইটের বোতল হাতে নিয়ে মুখ খুলতে খুলতে বলে, অমল অফ যা। তোর শালা কমনসেন্স নাই। বলে বোতলে চুমুক দেয়। অমলের বোধহয় হঠাত আসল কথা খেয়াল হয়। কিন্তু নিজের বলা আগের কথাকে সাপোর্ট করতেই হয়তো বলে, তোরা খালি প্রবলেম আমদানি করস। এমন একটা দিন, কই মৌজ করুম তা না।
এইটুকু বলে অমল এদিক ওদিক তাকায়।
শুয়ে থাকা টিটোর হাতে এখন নিয়াজের স্প্যানিশ গীটার। টুং করে একটা তারে আওয়াজ তোলে। অমল টিটোর দিকে তাকিয়ে হাসতে চেষ্ঠা করে।
অমলটা বোকাটে। ভেবেচিন্তে কিছু বলে না।
আমি হ্যাভারসেকটা সরিয়ে নিচে রেখে চেয়ারটায় বসে পড়ি।
কিছু মুহুর্ত কথাহীন কেটে যায়।
নিরবতা কাটাতে হাদু রনিকে জিগ্গাসা করে, ভাবিষ্ট, তোর বালের ঘড়িতে কয়টা বাজেরে?
-সাড়ে নয়টা।
-খিদা লাইগা গেল।
এইবার নিয়াজ উঠে গিয়ে আলনায় ঝুলানো জি্নসের প্যান্ট হাতে নিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে। আজ রাতে ওর আমাদের সবাইকে নান আর চিকেন টিক্কা খাওয়ানোর কথা। পাচশোঁ টাকার একটা নোট বের করে অমলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিয়াজ বলে, যা, তোরা কি খাবি নিয়া আয়।
কথার মধ্যে ঝাঝ টের পাওয়া যায়।
কমল জোরে বলে উঠে, যা অমল তাড়াতাড়ি নিয়া আয়। খাওয়ার পর সবাই মিলা বইসা নিয়াজ আর তুলির ব্যাপারটা একটু ভাবতে হবে। এমনি এমনি তো ছাইড়া দেয়া যায় না। কিছু করন লাগবো।
নিয়াজ টিটোর হাত থেকে গীটারটা বলতে গেলে কেড়ে নেয়। তারপর বলে, আমার ব্যাপার নিয়া তোদের কাউকে কিছু ভাবতে হবে না। তোরা বাল কি খাবি খা, তারপর যারযার মত বাড়ি যাগা।
স্পষ্টতই রাগত স্বর।
অমল দ্রুত বের হয়ে যায়। বশির আমার দিকে তাকায়। কেউ কিছু বলে না।
কারেন্টটা আবার চলে গেলে সুনসান নিরবতার দেহ ফালি ফালি করে কেটে ফেলতেই হ্য়তো গীটারের তারগুলো অহেতুক কেঁপে উঠে।

৩.
অমল খাবার নিয়ে আসে। এবং কিছুটা বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে কটা মোমবাতি।
মোমের আলোয় রাখা চিকেন টিক্কা, নান, সালাদ আর কোক - আমরা সবাই হাতে নিয়ে যার যার মতন আঁধারে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সাবার করে দেই সব। খাওয়া শেষে পরে থাকে শুধু কয়েকটা খালি গ্লাস, কোকের বোতল আর আমার হ্যাভারস্যাকে দুই বোতল মদ।
কারেন্ট তখনো আসে না।
হাদু সিগারেট ধরায়, তারপর রনি, তারপর কমল।
কিছুক্ষন পর সবাই মাল খাবো- চিন্তাটা সবার মনে গাঢ় হতে হতে নিয়াজে গিয়ে ধ্বস খায়।
হ্যাভারস্যাকে দুই বোতল বিদেশী জিনিস চুপচাপ শুয়ে থাকে।
সিগারেটের হাত বদল হয়। হাদু থেকে সুমন, কমল থেকে টিটু, রনির বাম হাত থেকে ডান।
তারপর মাল খাবো চিন্তাটা আবার সবার মনে ধীরে ধীরে ফিরে আসতে শুরু করে। আগের চেয়ে গাঢ় হয়। তারপর আমাদের সবাইকে ঘিরে চক্কর কাটতে শুরু করে। মাল খাবো, মাল খাবো, মাল খাবো।
এই সময় সিড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। থেমে থেমে।
কেউ আসছে।
নিয়াজ বলে উঠে, অমল একটা মোম নিয়ে দেখতো কে আসে?
অমল অনিচ্ছা নিয়ে উঠে মোমটা নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার চৌকাঠে গিয়ে দাড়ায়। ওখান থেকে সিড়ি দেখা যাওয়ার কথা।
তারপর মনে হয় আমরা কোনো সিনেমা দেখছি।
দরজার চৌকাঠে অমল, অমলের হাতে মোম। আমরা অমলকে দেখি।
সিনেমার দৃশ্য বদল হয়।
এখন দরজার চৌকাঠে অমল, অমলের হাতে মোম, মোমের আলোয় তুলির মুখ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন