পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০১০

যত সংকট সিংহপুরে

১.
সিঙ্গাপুরে এসে প্রথম প্রথম যা দেখতাম তাই ভালো লাগত। মুখর বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন দেশ পরিবেশ, বিভিন্ন ভাষা দেশ সমাজের মানুষ। সমস্যা একটাই, খাবার। এমন বিচ্ছিরি বদখত গন্ধ একেক খাবারের, খাই কীভাবে!

বেশ কয়েকজন সহপাঠি এসেছিলাম একসাথে। তাদের একজন শুভ্র, যা খায় তাই ভাল লাগে তার। প্রতিদিন একত্রে খেতে বসি আর যত গালি জানি খাবারের সাথে শুভ্রর গায়ে উগড়ে দেই। এদিকে ব্যাটা তারিয়ে তারিয়ে মালে, ইন্দোনেশিয়ান, চায়নিজ, জাপানিজ, ওয়েষ্টার্ণ আবজাব খায় আর বদন কেলিয়ে হাসে।
 অবস্থা এমন দাড়ালো, কেউ নতুন কোনো কিছু ট্রাই করার আগে জেনে নেয় সেটা শুভ্র খেতে পেরেছিল কিনা, ফাজিলটা যা খায় না সেটা নাকি অন্য কারো মামুশ্বশুরেরও সাধ্য নাই খাবে। এদিকে আমি যেটা খেতে পারি সেটা আর সবার কাছে নস্যি দিয়ে দুধভাত। আমি আর শুভ্র এইভাবে হয়ে গেলাম ভুখস্কেলের দুই এক্সট্রিম এন্ড।

আমার স্ত্রী নাতাশা সিঙ্গাপুরে আসে আমার এক মাস পর। সেই একমাস আমাকে কাটাতে হয়েছে খালি ইন্ডিয়ান ঝলসানো রুটি খেয়ে। নাতাশা আসার পরও যে শান্তিতে ছিলাম তা বলব না, সবেমাত্র বিয়ে, নতুন নতুন সংসার, বউকে কীভাবে বলি হেঁসেল ঠ্যালো এবং একজন মুমূর্ষু ভুখাকে বাঁচাও। তবে অন্নহীনে অন্ন দাও স্লোগানটা কাজে দিল। এদিকে একজন নিবেদিতপ্রাণ গিনিপিগ পেয়ে তখন বউয়েরও সাধ হয়েছে দ্রৌপদী সাজবার। ভাগ্যের পরিহাস, বেশ কিছুদিন ভুগলাম তার স্পেশাল (পড়ুন এই প্রথমবার) রান্নার একমাত্র চাখনেওয়ালা হয়ে। তাই বা কম কি! বাপের হোটেল ছেড়ে প্রবাসে এসেও যে ডালভাত জুটলো সেই অনেক।

প্রথম সেমিষ্টারের তখন প্রায় মাঝামাঝি, রোজা এসে গেল। এদিকে সিংহপুরে সারাবছর সূর্যোদয়-টু-সূর্যাস্ত বারোঘন্টার ধাক্কা। রোজা রাখতে হয় মিনিমাম চৌদ্দঘন্টা, এরমধ্যে সপ্তাহে তখন চারদিন ছয়টা-নয়টা ক্লাশ, তিনঘন্টা করে, মাঝে ব্রেক আসতে আসতে ইফতারটাইম পেরিয়ে আরো ঘন্টাখানেক। একটা জুস নিয়ে ক্লাশে ঢুকতাম। ব্রেকে একদিন পাশের মিনিশপের হটডগ খেয়ে সেই যে উহা খাওয়া ছেড়েছি, আর ধরি নাই।

মনে আছে, প্রথম বাজার। থাকি ক্যাম্পাসে, বিবাহিত গ্র্যাজুয়েডদের জন্য বরাদ্দ হাউজিংয়ে, হাঁড়িপাতিল বাদে ঘরকন্নার যাবতীয় সরঞ্জাম আছে। বাজারে গিয়ে প্রথমেই কিনলাম হাঁড়িপাতিল। এইসব কিনে ঠুকাঠুকি করে যখন ভাবছি এত জিনিস দেখে ট্যাক্সিওয়ালা আমাদের নিলে হয়, তখন মনে পড়ল কাঁচাবাজারটাই সারা হয়নি। তো কিনলাম আড়াই কেজি ওজনের রুই, ইলিশ বাদে এই একটা মাছই আমি চিনি। আর চাল কেনো, ডাল কেনো, নুন কিনোরে তো ছিলই, সাথে আবজাব ম্যালাকিছু।

কুস্তি করে মাছ তো বাড়ি নিয়ে আসলাম, কিন্তু এসে পড়লাম বিপদে। হাইটে আমার প্রায় অর্ধেক রুই ব্যাটাকে কেটে নিয়ে আসতে ভুলে গেছি। এখন উপায়? ছুরি একটা কিনেছি, মাশাল্লা সেটা দিয়ে গরু জবাই দিতে পারবে যে কেউ, কিন্তু এই বরফজমা পাথরশক্ত মাছ কাটব কীভাবে তা ভেবে পাই না দুজনের কেউই।জীবনে কিছু কাটি নাই, কেবল কুরবানির কাটাকাটি সম্বল করে ইয়া আলি বলে প্রথমে আমিই নেমে পড়লাম মাঠে। নামাই সার, মিনিট পৌনে একের মধ্যে ইস্তফা দিয়ে ফুট পাঁচেকের নিরাপদ দূরত্বে সরে দাড়াতে দাড়াতে বুঝলাম, সবসময় বীরত্ব দেখাইতে নাই, বিশেষ করে নতুন সংসারে। এইদিকে নাতাশা তখনও তার ভাষ্যে শুধু ছুরি দিয়ে মাছ কাটাটাই শিখে নাই (তখন যে কী কী তার সত্যি শেখা ছিল সেইটা একটা ইতিহাস), তার চাই বঙ্গদেশিয় পিরিওয়ালা বটি। রাত বাজে বারোটা। এই চিংকু অধ্যুষিত শান্তসমাহিত বাঙালিহীন প্রান্তরে কে দেবে সান্ত্বনা! অবশেষে রাত আড়াইটা নাগাদ হৈল মাছের দ্বিতীয় মৃত্যু, প্রথম খাদ্য হবার আগে। সারা গায়ে আঁশটে গন্ধ মেখে আমরা সুবোধ দুই বালক বালিকা নির্লজ্জের মতন ঢেকুর তুলে ঘুমাতে গেলাম।

২.

সিংহপুরে আসার আগেই থাকার জায়গা ঠিক করে রেখেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই, প্রিন্স জর্জ'স পার্ক (পিজিপি)। নেমেই একটা ঝামেলা বাধিয়ে ফেললাম। ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট থেকে পিজিপি এসে সেটাকে ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম - স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে! আর সেটা হচ্ছে আমি কত বড় নির্বোধের মত আমার হাতব্যাগটি ট্যাক্সিতে ফেলে এসেছি!

কিন্তু ততক্ষণে মহাকালের পাতা থেকে ঝরে গ্যাছে মহার্ঘ দশটি সেকেন্ড, ততক্ষণে ট্যাক্সি আমাকে রেখে অসভ্যের মত চলে গ্যাছে পঞ্চাশ গজ। পেছন থেকে হাত ইশারা করেও ট্যাক্সিওয়ালার দৃষ্টি ফেরানো গেল না। বুঝলাম, একটুর বেখেয়ালে এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এসে কী বিপদেই না পড়তে যাচ্ছি! আমার পাসপোর্ট, ভর্তির কাগজপত্র, টাকা - সব হতচ্ছাড়া ঐ হাতব্যাগেই।

সাথের মানিব্যাগে এক বড় ভাইয়ের ফোন নম্বর ছিল, এক চিংকু ছেলেকে অনুরোধ করায় সে তার ফোনটি ব্যবহার করতে দিল। ভাইকে সব খুলে বললাম। তখন সবে ভোর হয় হয়, তিনি বোধহয় অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সব শুনে টুনে বললেন, টেনশন নেহি লেনেকা, যো হো গ্যায়া তো হয়ে গ্যাছে (আমি শিউর, ফোনের ওপাশে তখন সে বাসিমুখে বিরাট ক্যালাচ্ছিল আমার ছাগলামির বয়ান শুনে)। জানতে চাইলেন, কোন ক্যাবে করে আমি এসেছি। এদিকে ট্যাক্সিতে যখন চড়ি তখন অন্ধকার ছিল, ট্যাক্সির গায়ে কোম্পানির নাম লেখা থাকলেও পড়া হয়নি। তখন কি জানতাম রে মনু কপালের লিখন! যাই হোক, বললাম যে নামটা জানি না, তবে ট্যাক্সির রং ছিল নীল। এটা শুনে তিনি বললেন যে তাহলে ওটা কমফোর্ট কোম্পানির ট্যাক্সি। আমাকে কোথায় নামিয়ে দিয়ে গেছে সেটা জেনে বললেন, তিনি কমফোর্টের লষ্ট এন্ড ফাউন্ডে ফোন করে ঘটনাটা জানাবেন আর আমি যেন কোনো চিন্তা না করি, ব্যাগটা পাওয়া গেলেই ওরা ফেরত দিয়ে যাবে।

আমার তো দিশেহারা অবস্থা। টাকা পাসপোর্ট সার্টিফিকেটসহ ব্যাগ হারিয়েছি বলেই আমি কি এতই আহাম্মক যে হারানো ব্যাগ আবার পাওয়া যাবে এই ভেবে বসে থাকবো! তিনি নিশ্চয়ই সান্ত্বনা দেবার জন্য কথাগুলো বলেছেন। যাইহোক, শুরুতেই এমন একটা বোকামি করে ফেলবো, এটা ভাবতেই পারছিলাম না। এখন একটাই করার মত কাজ, পিজিপি'র হাউজিং অফিস খোলার জন্য অপেক্ষা করা। ওদের বলে কয়ে যদি বাসার চাবিটা নেয়া যায়, তাহলে অন্তত লাগেজগুলো রাখা যাবে। এইদিকে ঐদিনই আবার আমার রেজিষ্ট্রেশনের তারিখ। অফার লেটার, পাসপোর্ট এগুলো ছাড়া আমাকে সেটা আদৌ করতে দেবে কিনা সে আরেক দুশ্চিন্তা। যাচলে, বিদেশ আসাটাই ভুল হোলো দেখছি... সেই এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই এই সব আবজাব ভাবতে ভাবতে কখন যে ন'টা বেজে গেছে খেয়াল নেই, হঠাৎ দেখি আমার সেই ট্যাক্সিওয়ালা!

সে ফিরে এসেছে আমার হারানো ব্যাগ ফেরত দিতে! পুরাই কস্কি মমিন সিচুয়েশন। আমি তো পারলে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাই। এ তো সাক্ষাৎ ফেরেশতা। ব্যাগটা ফেরত পেয়ে আমি তাকে থ্যাংকিউ বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেললাম।

আমার ধাতস্থ হতে সত্যিই অনেকক্ষণ লাগলো। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে ব্যাগটা আসলেই ফেরত পাবো। ট্যাক্সিচালক ঘটনা খুলে বললো। ওর নাম মাইকেল। আজকে ছিল ওর নাইট শিফট আর আমি ছিলাম ওর সর্বশেষ যাত্রি। আমাকে নামিয়ে দিয়ে মাইকেল চলে যায় ট্যাক্সি জমা দিতে। জমাটমা দিয়ে বাড়ি গিয়ে সবেমাত্র বিছানায় শুয়েছে এই সময় ওকে ফোন করে ফু কাং। এই বলে মাইকেল ওর পাশে দাড়িয়ে থাকা ফু কাংয়ের দিকে তাকালো। এতক্ষণে আমি খেয়াল করলাম, মাইকেল একা ব্যাগটা ফেরত দিতে আসেনি, আরেকজন ওর সাথে আছে, সে-ই ফু কাং। ফু কাং দিনের শিফটের জন্য ট্যাক্সি নিতে এসে দেখে যে ট্যাক্সির পেছনের সীটে পড়ে আছে আমার সেই ব্যাগ। সেটা পেয়েই ও মাইকেলকে ফোন করে।

তারপর মাইকেল আমাকে বলে ব্যাগটা চেক করে দেখতে, সব ঠিক আছে কিনা। আমি খুলে দেখি সব যেভাবে ছিল সেভাবেই আছে- পাসপোর্ট, সার্টিফিকেট আর অন্যান্য কাগজপত্র, অফার লেটার, টাকা, সব।
আমি মাইকেল আর ফু কাং কে বলি, তোমরা যে উপকার করলে তার ঋণ আমি কিছুতেই শোধ করতে পারবো না, শুধু তোমাদের এখানে আবার আসতে যে সময়টা নষ্ট হয়েছে সেই সময়টার দাম হিসেবে আমি কিছু টাকা তোমাদের দিতে চাই। ওরা তা কিছুতেই নেবে না। বলল, লষ্ট এন্ড ফাউন্ডে তো কল গিয়েছিল, আমরা না আসলেও ওদের কেউ ফেরৎ দিতে আসত, আমরা শুধু এসেছি তুমি একজন বিদেশি, ব্যাগটা না পেলে তোমার সমস্যা হবে সেজন্য। ফু কাং বললো, তুমি এটা নিয়ে ভেবো না, ব্যাগটা ফেরৎ দেয়া আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।

আমি বললাম, তবু তোমরা টাকাটা রাখো। অনেক জোরাজুরির পর ওরা টাকা নিতে রাজি হোল। যাবার আগে বলে গেল, বি কেয়ারফুল নেক্সট টাইম।

সে আর বলতে! মনটাই ভালো হয়ে গেল। এমন একটা ঘটনায় শুধু আশু অনেক সমস্যার হাত থেকেই রক্ষা পেলাম তাই নয়, মাইকেল আর ফু কাংয়ের কল্যাণে সিঙ্গাপুরের উপর একটা ভালো ধারণা মনে ঢুকে গেল, যা আজ পর্যন্ত আছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন