১.
ঠিক এক বছর পর আবার কাতার আসতে হলো।
প্রজেক্টের কাজে গতবছর এই সময়েই দু'মাস কাতার থাকতে হয়েছিল। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। পণ করেছিলাম, যেখানে রোদের তাপে খেজুর গাছের পাতাও পুড়ে খাঁ খাঁ, সেই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে আর আসবো না। অন্ততঃপক্ষে গ্রীষ্মে (মে- আগস্ট) তো নয়ই।
'পণভাঙ্গা পরিস্থিতি' বলে একটা কথা আছে। এর সংজ্ঞা হলো, যে পরিস্থিতিতে শুধু মন্দ-কপালের মানুষেরা মাঝে মাঝে নিপতিত হয়। এমনই এক অবস্থার শিকার হয়ে পণ ভেঙ্গে আবার আসলাম শেখের শেখ কাতারীদের দেশে।
গতবারের কথা ভুলিনি। ভুলি কীভাবে! চল্লিশ ডিগ্রি রোদমাত্রা আর বাতাসে নব্বইয়ের ঘরে আর্দ্রতাযুক্ত কাতারী গ্রীষ্মাবকাশ কি ভোলা যায়! তবে এই মরুভূমি আর বেদুইনের দেশে গতবার গরমের চাইতেও বেশি ভুগিয়েছিল সর্দি। হ্যাঁ, সর্দি। অতিরিক্ত গরমে অতিষ্ঠ হয়ে বরফ কুসুম পানি আর অহর্নিশ শীতাতপ যন্ত্রের হিমেল হাওয়া খেয়ে বংশগতিসূত্রে পাওয়া এলার্জিকে দিয়েছিলাম উস্কে। সাথে ধূলিময় লু-হাওয়া তো ছিলই।
এবার তাই অতিমাত্রায় সতর্ক হয়েই গরমে ঝিম মেরে যাওয়া আর ধূলাশার (ধূলার কুয়াশা) চাদরে ঢাকা রাজধানী শহর দোহা'য় পা দিলাম।
২.
সৌদিআরব-ইয়েমেন-ওমান নিয়ে গড়া ভৌগোলিকভাবে বিশাল ভূ-খন্ডটি যেন ভারত মহাসাগরের পারে ধ্যানে বসা এক মৌন ঋষি, আর কাতার যেন তার কোলে বসা এক দেবশিশু। দেশটার আকৃতি বামহাতের পাঁচটি আঙ্গুল একসাথে সোজা করে রাখলে যেরকম দেখায় অনেকটা সেরকম। আর রাজধানী দোহার অবস্থান তখন ঠিক বুড়ো আঙ্গুলের ডগায়। এই অঞ্চলের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীনকালে এর উপর দিয়েই ছিল মেসোপটেমিয়া হয়ে সিন্ধু উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত বিখ্যাত ‘ট্রেড রুট'। আমির শাসিত বর্তমান কাতারের শাসনভার প্রায় দু'শো বছরের পুরানো বিখ্যাত ‘আল-থানি' পরিবারের হাতে ন্যস্ত।
গাল্ফের (GULF)পারের দেশ কাতার। এরা এপারে দাঁড়িয়ে বলে, ‘ইয়া ব্রাদারানে আরব ,ইহা এরাবিক গাল্ফ‘। পারস্যদেশের খলিফারা তখন হুংকার দিয়ে বলে উঠে, ‘বললেই হলো! এটা পারসিয়ান গাল্ফ‘। আর সেই সাগরের তীরে বসে মৃদু হাওয়া খেতে খেতে আমি ভাবি, এটা কোনো ইস্যু হলো! শেক্সপীয়ার বলেছেন, নামে কি আসে যায়!
গায়েবি আওয়াজ আমাকে কষে থাপ্পড় লাগায়,ইস্যু আছে রে পাগল। দুনিয়ার সব থেকে বড় পানির তলের প্রাকৃতিক গ্যাসের খনি এই গাল্ফের তলায়। বাংলাদেশের সকল উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের চাইতে মাত্র ৬০ গুণ বেশি। এই বেলায় আরব্য-পারস্য কাইজ্যার কারণ বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না আর।
কাতারী, মানে কাতারের নাগরিক আগে হয় ছিলো বেদুইন, নয়তো মুক্তার ডুবুরী। একদিন বালিয়াড়ির পাশে খেজুর পাতায় দেয়া ঘুম থেকে জেগে উঠার পর দেখে, তেল আর গ্যাসের উপরে দেশ দুনিয়া ভাসে। সেই থেকে বেদুইন উটের বদলে টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার চালায়।
ল্যান্ড ক্রুজারের বিষয়ে আমার থিওরি হলো, হাজার বছর ধরে উট চালানোর পরে নিচু কোনো জিনিস আর বোধহয় শেখ সাহেবদের ভালো লাগে না। তাই উঁচু উঁচু পাজেরো; রাস্তাঘাটে শুধু এই জিনিস। হিউম্যান রিসোর্সের আহ্-লান-ওয়া-সাহ্-লান কাজে নিযুক্ত যে ইংলিশমূর্খ শেখ সাহেব আমাকে এয়ারপোর্টে নিতে আসলেন, তার পাজেরোটা দেখে মনে মনে বলেছিলাম, ‘ব্যাটা, এই জিনিস তোর নিজের হতেই পারে না, নির্ঘাৎ আমিরের বাড়ি থেকে চুরি করে এনেছিস।’
পরে ইশারা ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কি তোমার?’
শেখের ব্যাটা তখন এক পা এক্সেলারেটর আর অন্য পা সীটের তলে মুড়িয়ে ডানহাতে তছবি আর বামহাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে মারহাবা মারহাবা মার্কা গান শুনতে শুনতে যান্ত্রিক উট চালাচ্ছিলো; আমার প্রশ্ন বুঝতে পেরে তছবিওয়ালা হাতটাকে সে উদাসভাবে উপরে তুলে দেখালো। বুঝলাম, সবই উপরওয়ালার কুদরত।
৩.
দোহার রাস্তাগুলোও মাশাল্লাহ। সিগনালের বদলে খালি ঢাকার শাপলা চত্বর। সার্কেলে যে যেভাবে পারে গাড়ি ঢুকাচ্ছে, আবার হুশহাশ বের হয়ে যাচ্ছে। আর সোজা রাস্তায় লেন বলে যে একটা জিনিস আছে সেটা বোধহয় আরবি ডিকশনারিতে নেই। কাতারে প্রাপ্তবয়স্ক মৃত্যুর কারণের তালিকায় গাড়ি দুর্ঘটনা তিন নম্বরে। গতবছর প্রজেক্টের গাড়ি ছিল, সেটা চড়ে দোহা'র রাস্তায় ঘোরাঘুরির পর এবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেছি, আমার গাড়ির শখ নাই।
এতে অবশ্য একটু কষ্ট হয়ে যাচ্ছে;কাতার তো আর জাপান কিংবা সিঙ্গাপুর না যে ছায়া সুনিবিড় কিংবা ছাদওয়ালা করিডোর ধরে একটু এগুলেই বাসস্টপ যেখানে পটাপট একের পর এক গাড়ি এসে থামে। প্রায় সকল কাতারীই বড় লোক হওয়ায় আর গাড়ির দাম এবং তেলের দাম পানিতে এসে ঠেকায় তারা মনে হয় ধরেই নিয়েছে যে, পাবলিক সার্ভিসের কোনো দরকার নেই। ভাবখানা এমন, ‘বাস! উহা আবার কি?’
তাই কলিগদের কাছ থেকে লিফট নিয়ে আর শাটলমাইক্রো দিয়ে ইনডাস্ট্রি-ভার্সিটি-গেস্ট হাউজ করা। ট্যাক্সির চিন্তা না করাই উত্তম, অনেকসময় কল করলেই আসে দুই ঘন্টা পর, তার জন্যে মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে না থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।
দোহার রাস্তাঘাটগুলো পরিস্কার। তবে আইল্যান্ড বা মোড়গুলোতে জোর করে গাছ বা ঘাস লাগানোর চেষ্টা দেখলে সত্যিই হাসি পায়। সকাল-সন্ধ্যা এই যে পানি ঢালছে, তবু সব গাছের জন্ডিস আর সারে না। আর ঘাসগুলো যে কেন লাগায়! লাগানোর ঘন্টাখানেক পরই মনে হয় রোদে পুড়ে শেষ। যা থাকে তা ঐ এক ও অদ্বিতীয় খেজুর গাছ। তবে বলতেই হয়, এখন এই খেজুরের মৌসুমে বাটু বাটু গাছগুলো যেভাবে খেজুরের ভারে রাস্তায় নূহ্যমান, তাতে মনে হয় গাড়ি থামিয়ে মুঠো মুঠো খেজুর মুখে দিয়ে মুখ ভরে ফেলি।
৪.
এসে যেখানটায় উঠেছি সেটাকে বলা যায় বেশ ডাকাবুকো এলাকা। জায়গার নাম আল-সাদ। পাশেই ফিলিপিনো স্কুল। কাতারে প্রচুর ফিলিপিনো নাগরিক; অফিসে, হাসপাতালে, শপিংমলে। বেশিরভাগই ক্লারিকেল জব করে। স্কুলটা তাদের বাচ্চাদের জন্যই। কাউকে এই ‘ফিলিপিনো স্কুলের’ কথা বললেই আল-সাদ এলাকার কোথায় থাকি তা চিনে ফেলে। সকাল-বিকাল যখন অভিভাবকেরা বাচ্চাদের আনা-নেওয়া করে, তখন এলাকাটাকে আর মধ্যপ্রাচ্য বলে মনে হয় না। কারণটা পোষাক। কাতারে ফাইভ স্টার হোটেল আর শপিংমলের বাইরে বোরকা-হেজাব ছাড়াও যে মেয়েদের দেখা মেলে সেটা এখানেই। প্রায়শই দেখি, পথ চলতিরা তাকিয়ে আছে। এখানে অবশ্য বলে নেয়া ভাল, দোহার পথে পথিক খুবই কম। এই গরমে, রাতে ছাড়া আর গাড়ি ছাড়া কার সাধ্যি বের হয়! আর পথিকদের বেশিরভাগই শ্রমিক। অন্ততঃ দুই গ্রীষ্মে তাই দেখলাম। অন্যসময়ের কথা জানি না।
কাতারের খাবার-দাবারের ব্যাপারে ভালো-মন্দ কোনো কিছু নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। ট্র্যাডিশনাল খাবারের মধ্যে পড়ে শুকনা রুটি। কিন্তু ওটা শুধু টেবিলের শোভাবর্ধনের জন্যই, কেউ খায়, কেউ খায় না। আসলে, পাশে যদি হরদম বিরিয়ানি, রোস্ট আর কাবাব থাকে তাহলে ওই রুটি খাবার প্রয়োজনও হয় না। মানুষ কীভাবে এই গরমে এই সব খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকে, এটা একটা প্রশ্ন বটে!
এরমধ্যে এসে আমার মত ভেতো বাঙালির হয়েছে মহামুশকিল। তার উপর চিজ-বাটার-হানি আর মুরগি-দুম্বা-গরুর ভিড়ে স্বাদু পানির মাছের নামগন্ধ নেই। এসব বস্তাভারী খাবার খেয়ে তাই প্রথমদিন টানা পনেরো ঘন্টা ঘুমিয়েছি।
তবে শুকনা রুটিটা খাওয়ার মত। এটা আরবরা খায়ও দারুণ সুন্দর করে। প্রথমে দুই টুকরা করে, তারপর এক টুকরা নিয়ে মাঝবরাবর চিরে ভেতরে শুকনা মাংস, রোস্ট, সালাদ হাবিজাবি যত কিছু আছে ঠেসে ভরে আস্ত একটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে ফেলে। সামনে বসে কেউ যখন ধীরেসুস্হে এই জিনিস তৈরি করে, তখন মনে হয় কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলি। হাত কাটা যাবার ভয়ে অবশ্য তা করা হয়ে ওঠে না!
ফলমূলের মধ্যে যেটার কথা না বললেই নয়, তা হলো জয়তুন। জয়তুন ফল সাধারণতঃ পানিতে ভিজিয়ে রেখে খাওয়ার নিয়ম। কেবল স্বাস্থ্যগত কারণেই নয়, এইখানে জয়তুন সহজলভ্য একটি ফল এবং এই ফলের ধর্মীয় গুরুত্ব আছে। আকারে অনেকটা জামের মত হলেও স্বাদে কিন্তু ততটা না। তারপরও এই ফলটি এখানে খাবারের এক অপরিহার্য অনুসঙ্গ হয়ে আছে।
৫.
মাটির তলে তেল আর গ্যাসের ভুস-ভাস শব্দে ইউরোপ-আমেরিকার সকলে এসে হাজির মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। এই কাতারেও। এদের দেখলেই আমার ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনার খনির মালিক হবার লোভে মত্ত গোঁয়াড় পশ্চিমা পাপীদের কথা মনে পড়ে যায়। সবাই যেন জিহ্বা বের করে আছে। কাতারীরা তো নিশান ফোর হুইল ড্রাইভ, এসির বাতাস আর আলিশান বাড়ি পেয়েই খুশি। এই ফাঁকে এমন কোনো এমএনসি (মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী) নাই দুনিয়ায় যে কাতারে আসেনি। শেল, শেভরন, সেসল, এক্সনমোবিল, জি.ই.,কোনোকো, ফিলিপস, ডলফিন, টোট্যাল, আরো কত যে অয়েল মেজর, গ্যাস মেজরে দেশটা ভর্তি!
কথা সেটা না। কথা হলো, উঠতি দোহা সিটি। কে জানি বলছিল, মনে হয় দুনিয়ায় যত ক্রেন আছে তার চার আনাই এখন দোহায়। কারণ, কনস্ট্রাক্শন। এমনিতে সুন্দর সুন্দর একতলা, দোতলা বাড়িই বেশি চোখে পড়ে। তবে নতুন নতুন টাকা হলে যা হয়, মানুষকে দেখাতে হবে না! আমির বলেছে, বানাও উঁচু উঁচু বিল্ডিং। ত্রিশ তলা, চল্লিশতলা, আরো বেশি উঁচু হওয়া চাই। দেশের লোকসংখ্যা মোটে আট লাখ (দুই লাখ কাতারী, বাকি অন্যদেশী শ্রমজীবি), কে থাকবে ঐ আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া ইমারতে! তবু এশিয়ান গেমস দেখতে যারা এসেছিল, তেলের টাকা কামড়াকামড়ি করতে যারা আসে,গলফ আর টেনিস ওপেন দেখতে যারা আসবে,যেই আসুক তাদের দেখাতে তো হবে যে এখন এই দেশ আর সেই দেশ নাই, এই দেশ এখন আলো ঝলমলে ‘গ্যাস ক্যাপিটাল’!
পারস্য উপসাগরকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে গড়ে ওঠা দোহার আরেক অন্যতম আকর্ষণ একেবারে সাগর ঘেঁষে চলে যাওয়া রাস্তাটি, যাকে এখানে বলে ‘কর্ণিশ’ বা ‘কর্ণিচ’। আমিরের বাসভবন থেকে শুরু করে যাবতীয় পাঁচতারা হোটেল, অফিসপাড়া, ঘাট, উদ্যান, পার্ক, রেস্টুরেন্ট সবই এই সাগরের কূলঘেঁষা রাস্তার দুপাশে।
দোহার শপিংমলগুলো দেখে ধাক্কা খেয়েছি। ‘সিটি সেন্টার’ নামে দোহায় একটা শপিং কমপ্লেক্স আছে। আলিশান বললে কম বলা হয়। পশ্চিমের মেসি’স কিংবা সিঙ্গাপুরের ভিভোসিটিও এর কাছে হার মানবে মনে হয়। কী নেই! দুনিয়ার সব ব্র্যান্ড এসে হাজির। শুধু সিটি সেন্টার নয়, এরকম আরো কি কি যেন আছে, ভয়ে আর যাই নি। পকেটের যা অবস্থা!
৬.
ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রজেক্টে কাতার আসা, বেশ কয়েকবার তাই এখানকার শিল্প এলাকায় যেতে হলো। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার প্রায় সব শিল্প-কারখানাই তেল-গ্যাসভিত্তিক। পরিকল্পনা থাকলে কতটা দারুণভাবে সব শিল্পকে একসাথে ইন্টিগ্রেড করা যায়, সে ব্যাপারে কাতারকে আদর্শ ধরা যেতে পারে। দোহা থেকে প্রায় সত্তর-আশি কিলোমিটার দূরে উত্তরাঞ্চলে পুরো একটা শিল্পশহরই গড়ে তোলা হয়েছে, যার নাম ‘রাজ-লাফান ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিটি’। শহর থেকে দূরে, সমুদ্রের তীরে আর খনিগুলোর কাছে হয় এমন একটা জায়গায়।
দোহা থেকে রাজ-লাফান যাবার পুরো রাস্তাটাই যেন মরুভূমির বুকে কালো সাপের মত শুয়ে থাকা হাইওয়ে। হাইওয়ের কিছুদূর পর পর রাডার সারভিলান্স সিস্টেম থাকলেও গাড়িগুলোর স্পিডোমিটারের কাঁটা প্রায়শই দেড়শো কিলোমিটার ছুঁই ছুঁই করে। নিশান পেট্রোলে চড়ে বাইরের মরুভূমির আর কতটাই বা আঁচ করা যায়! তাই রুক্ষতার বদলে সৌন্দর্য্যটাই ধরা পড়লো বেশি। এখানকার মরুভূমি সমতল, একদম বালুকাময় না হয়ে মাটি একটু পাথুরে, রং একটু লালচে। চোখ মেললে দূরে বেশ কয়েক মাইল পর্যন্ত দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর পর ধু-ধু মরুভূমির মাঝে এখানে ওখানে কিছুটা ঝোঁপ-ঝাড় আর হয়তো দু’একটা বাড়িঘর। আর ভাগ্য খুব ভাল থাকলে কয়েকটা ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো উটও দেখে ফেলতে পারেন।
আর সবচেয়ে দারুণ লাগে রাতের বেলা; মরুর বুকে রাতের হাইওয়ে - এক কথায় অসাধারণ!
রাজ-লাফান যাবার পথে পড়ে আরেকটা শহর, আল -খোর। এটা যদিও দোহার পর কাতারের অন্যতম একটা শহর, কিন্তু দেখে বাংলাদেশের সাধারণ যে কোনো উপজেলা শহরের চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। আসলে সবাই এখন দোহামুখী। কারণটা খুব সহজ, দোহাকেন্দ্রিক আধুনিক কাতারের সবকিছুই এখন দোহায়।
৭.
ছোটবেলায় সবচেয়ে ভয়ংকর কাজের মধ্যে একটা ছিল, প্রতি শুক্রবার বিকালে আরবি শিক্ষার বই নিয়ে মসজিদে মাওলানার কাছে দল বেঁধে আরবি শেখা। খেলা বাদ দিয়ে কার শখ হয় খটমট আরবির কুল আর ক্বুল এর পার্থক্য গলায় ফুটিয়ে তুলতে! কাতারে এসে সেই আরবি ভাষার সাগরে আবার পড়লাম।
কাতারের ভাষা মূলত আরবি। শুধু কাতার বলি কেন, পূর্বে বাহরাইন, সৌদি, ওমান থেকে শুরু করে চাদ, মরক্কো, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, সুদান, ইরাথ্রিয়া হয়ে আফ্রিকার পশ্চিম তীরের মারাথানিয়া পর্যন্ত আরবি ভাষার প্রচলন। ওদিকে মিশর, জর্ডান, সিরিয়া তো আছেই। এদিকে ইরাক, প্যালেস্টাইন। সব জায়গায় আরবি। এই সব দেশের অসংখ্য মানুষের বাস কাতারে। অফিস-আদালতে ভুরি ভুরি মিশর, ওমান, সিরিয়ার লোকজন। এত দেশের লোক, অথচ ইংরেজির চল ততটা নেই। এর কারণ একটাই- আরবি ভাষা। একটা ভাষার মাধ্যমে গড়ে ওঠা সর্বত্র এক নিদারুণ আত্মীয়তার বাঁধন দেখে আমি মোহিত। নানান আরব দেশ,পোষাকে অল্পবিস্তর যা পার্থক্য কিন্তু ভাষা; সবার এক। সুতরাং আরবি জানাটা এখানে জীবনধারণের জন্য বলতে গেলে আবশ্যক।
চাইনিজদের সাথে থেকে যেমন ‘নি হাউ মা’ কিংবা ‘শিশিয়ে’ না জানলে কেমন দেখায়, তেমনি এখানে এসে কিছু আরবি শিখলাম। এর কিছু অল্পবিস্তর সবাই জানি, বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে যা। কিছু আবার জানতাম ভুল অর্থে। যেমন, ‘মারহাবা’। যার মানে জানতাম সাবাশ বা উৎসাহ দেওয়া, এখন তার মানে দেখি আসলে স্বাগতম! এছাড়াও অনেকগুলো কথা যেমন, ‘কাইফালাক’ যার মানে কি খবর বা কেমন আছেন। শিখলাম ‘ইয়া হাবিবি’। মানে হে আমার প্রিয়তম বা হে আমার বন্ধু! তারপর ‘মা ইস্মুকা’ মানে তোমার নাম কি? আরো কিছু আরবি শব্দ, যেমন শুকরান (ধন্যবাদ), নাআম (হ্যা), লা (না), মওজুদ (বর্তমান বা উপস্থিত থাকা), খতর (বিপদ বা বিপদজনক)।
কিছু সংখ্যা গণনাও শেখা হলো। গতবার যখন এসেছিলাম তখন বিশ্বকাপ ফুটবল চলছে। স্কোর কত জানতে চাইলে জবাব শুনতাম, ‘ওয়াহিদ-ওয়াহিদ’ মানে এক -এক । তবে আরবি গণনা আসলে এত সহজ নয়, এরা ৬০ কে বলে চল্লিশের পরে বিশ, কিংবা তার চেয়েও কঠিন কিছু। আরবি ভাষাটাই আসলে কঠিন এক ভাষা। এত ক্রিয়ার প্রকারভেদ আছে যে নাভিশ্বাস উঠে যাবে ঠিকমত শিখতে। তার উপর হিন্দির মত স্ত্রীলিঙ্গ-পুরুষলিঙ্গের ব্যাপারতো আছেই।
তবে বহুল উচ্চারিত আরবি শব্দ নিঃসন্দেহে ‘খালাছ্’ (কাছাকাছি অর্থ ইংরেজিতে done)। আমার মনে হয়েছে,কথায় কথায় খালাছ্ বলাটা আরবদের একটা সাধারন মুদ্রাদোষ, অনেকটা আমাদের বাঙালিদের কথায় কথায় ‘আচ্ছা’ বলার মত।
সপ্তাহে শুক্র আর শনি এই দুইদিন এখানে ছুটির দিন। এছাড়া প্রতিদিন সাতটা থেকে দুপুর দুইটা হলো অফিসটাইম। সকালে আরাম করে ঘুমানোর চান্স এখানে নাই। এই দুইদিন কোনো কাজের শিডিউল ছিল না।
ছুটি পেয়ে তাই বড় কাজ ছিল ঘুমানো। দেখলাম কাজটা সহজও। আমি সাধারণত দিনে ঘুমাতে পারি না। অথচ এখানে একটু শুলেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে যায়। মরু আবহাওয়া আর ভারী খাবারের মিথষ্ক্রিয়া।
জেগে থেকে যা করলাম তা হলো টিভি দেখা। সেটাই বলি।
অনেক চ্যানেল। দু’একটা ছাড়া প্রায় সবই আরবি ভাষার। বিভিন্ন দেশের চ্যানেল দেখলাম। মিউজিক অবশ্য সবই গতানুগতিক মনে হলো। ‘ইহা হাবিবি’ টাইপ। মিউজিক ভিডিওগুলোতে আরব্য বেদুইন সংস্কৃতি তুলে ধরার চেষ্টা। কিছু গান যেগুলোকে মনে হলো মূলধারার, তার সাথে দেখানো হচ্ছে আরবীয় পোষাকে কিছুসংখ্যক যুবকের নাংগা তলোয়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে নাচানাচি আর একটু দূরে কতিপয় সিল্কি পোষাক পরিহিত আরবীয় রমণীর দাঁড়িয়ে বা বসে মাথার চুল চক্কর মেরে দোলানো। মনে হলো এটাই গান উপভোগের বেদুইন ফর্মুলা। মেয়েদের মাথার চুল ঘোরানো মনে হলো খুবই সাধারণ। একই জিনিস দেখে দেখে বিরক্ত হবার যোগাড়।
দেখলাম কাতারী, ওমানি আর সৌদি চ্যানেল, বেশিরভাগই এখনও বিটিভিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। আরো দেখলাম বিখ্যাত আল জাজিরা, মনে হলো বিবিসিকে অনুকরণ করার আরবীয় চেষ্টা। অনেক চ্যানেলেই ফুটবল। সৌদি চ্যানেলগুলোয় ঘোড়দৌড়, দুবাই চ্যানেলে মোটর রেস। দেখলাম তালির তালে তালে আফ্রিকান ড্যান্স, আমির-ওমরাহদের বাতচিত, লাইভ জুয়ার চ্যানেল, খেজুর গাছের তলে বেদুইনটাইপ সেট বানিয়ে পাশে উট রেখে সাক্ষাৎকার, কউন বানেগা ক্রৌড়পতির আরবি সংস্করণ এবং অবশ্যই একটা হিন্দি গানের সিডি চালানো লোকাল চ্যানেল। দুর্লভ দুয়েকটা ইংরেজি চ্যানেলেও নিচে আরবি সাবটাইটেল। সবমিলিয়ে জমজমাট আরব্য বায়োস্কোপ।
৮.
হাতে সময় খুব কম আর কাজ খুব বেশি থাকায় এবার আর দোহা কিংবা অন্য কোথাও ঘোরাঘুরি হলো না। তবে বেশ কয়েকবার যাওয়া হলো কাতার ইউনিভার্সিটি,তাও কাজের ছুঁতোয়। এর অবস্থান দোহার উত্তর প্রান্তে। আর্কিটেকচারাল ভিউটা সুন্দর। মিশরীয় এক ভদ্রলোকের ডিজাইনে জ্যামিতিক খাঁজে এমবেডেড আরবীয় ধাঁচের নকশা করা অনতিউচ্চ বিদ্যালয় ভবন- দূর থেকে দেখতে বেশ লাগে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ভবন। মেয়েদের ভাগে কোনো পুরুষ শিক্ষার্থীর প্রবেশ একেবারে নিষেধ। মেয়েদেরও ছেলেদের অংশে আসা মানা। শুধু শিক্ষকরা উভয় অংশে যেতে পারেন বাধা ছাড়াই।
কাতারীরা দেরিতে হলেও ইদানীং বোধহয় শিক্ষার মূল্য বুঝতে পারছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের প্রায় দ্বিগুণ দেখে অন্য আরব দেশের তুলনায় নারী শিক্ষার ব্যাপারেও কাতারকে একটু এগিয়ে থাকতে দেখা গেল।
আসলে শিক্ষাব্যবস্থায় কাতার একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। পুরাতনের পাশাপাশি বাংলাদেশের মত এখানেও উঠছে নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে কোনোটাই বাংলাদেশের মত ভুঁইফোড় কিংবা ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়। সবই হচ্ছে সরকারের ‘কাতার ফাউন্ডেশন’ নামক সংগঠনের পরিকল্পনায় ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে, সম্পূর্ণ আলাদা কায়দায়, অন্য উদ্দেশ্যে। গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি এই ফাউন্ডেশনের দায়িত্বে হচ্ছে তা হলো বিশ্বের সবচেয়ে নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাতার ক্যাম্পাস চালু করা। ইতোমধ্যেই এখানে আছে কার্নেগি মেলনের বিজনেস স্কুল, কর্ণেল ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত মেডিক্যাল স্কুল,জর্জটাউনের ফরেন সার্ভিস স্কুল, টেক্সাস এ এন্ড এম-এর ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল, ভার্জিনিয়া কমনওয়েল্থের স্কুল অব আর্টস। এই দারুণ সব স্কুলগুলোতে কেবল কাতারীরাই পড়তে পারবে, প্রয়োজনে স্কলারশীপসহ। বোঝাই যাচ্ছে,পেট্রোডলারের সদ্ব্যবহারও এরা করতে জানে।
দেখছিলাম আর আফসোস হচ্ছিল। আমার দেশেও যদি এমনটা হতো! কত মেধাবী বাঙালী সন্তানের সুযোগ হতো দেশে থেকেই এই স্কুলগুলোতে পড়ার, কমে যেত ব্রেন ড্রেইন। দেশে থেকেই যদি বিশ্বের সবশ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের জ্ঞান আহরণ সম্ভব হয় তাহলে আর লাগে কিছু?
৯.
বর্ষা-বাদল-বৃক্ষ-বন-বসন্তে বোনা বঙ্গদেশের সন্তান বলেই হয়ত মরুভূমি আর লু-হাওয়ার দেশ ততটা টানে না, তবু সব মিলিয়ে অন্যরকম অনুভূতিই হল কাতারে। যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে দু’বারই গ্রীষ্মকাল হওয়ায় খুব বেশি উপভোগ্য হয়ে ওঠেনি কাতার ভ্রমণ। এত বেশি আর্দ্রতার সাথেও এর আগে বোঝাপড়া ছিল না। কিন্তু তারপরও যখন ফিরে আসার সময় ঘনিয়ে আসলো, একটু আফসোসের কাঁটা যে মনের মধ্যে খচখচ করলো না তা নয়। অনেককিছুই তো দেখা হলো না কাতারের। এখানকার প্রাচীন স্থাপত্য, সভ্যতার অবশেষ কিংবা জাদুঘর দেখা হলো না। হলো না পাম ট্রি আইল্যান্ডে যাওয়া, যদিও মনে হলো ওখানে আর যাওয়া যায় না, কিছুই আর নেই সেখানে। আরবদের পারিবারিক জীবন কাছ থেকে দেখার শখ ছিল, এত অল্প সময়ে তা সম্ভব নয়। খুব ইচ্ছে ছিল এখানকার অতীত জীবনপ্রবাহ সম্পর্কে জানার, পারলে শহর ছেড়ে বেদুইনদের (যদি থাকে আদৌ) জীবন কাছ থেকে দেখার। হয়ে ওঠেনি।
তবু বলতে হয়, ভালো একটা অভিজ্ঞতাই হলো। শহরের দোতলা বক্স বাড়িগুলোর দেয়ালে দেয়ালে চৌকোণা সূক্ষ্ম আরবীয় খাঁজ, ছোট করে ছাঁটা দাঁড়ির কাতারি পুরুষের শুভ্র আরব পোষাকে ধুপ-দুরস্ত চলাফেরা, চেনা-অচেনা যেই হোক অসম্ভব আন্তরিকতায় সালাম-কুশলাদি বিনিময়, ছায়াহীন দোহার রাস্তায় খাসির শর্মা খাওয়া, গরম বাঁচিয়ে রাত বারোটার ফুটবল, সেলান (sea line)এ শয়তানের সাহস নিয়ে তরুণদের কার রেস এবং মুখোমুখি সংঘর্ষের ডুয়েল, কাতারি রুটি-মাংস-জয়তুন, এদের অনেককিছুই মনে থাকবে অনেকদিন।
তাই যখন ফিরছিলাম দশ দিনের পুরো প্যাকেট একটা ট্যুর শেষে, তখন মনে হলো দোহা শহরকে আপন করে নেবার অনেক উপকরণই বোধহয় মনের কোণে জমা হয়ে গেছে।
এই লেখাটি লিখেছিলাম ২০০৬য়ে কাতার ঘুরে এসে।
উত্তরমুছুনঅফিসের কাজে কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল।
উত্তরমুছুনপ্রচুর কনস্ট্রাকশনের কাজ হচ্ছে এটা চোখে পড়েছে।
এই লেখাটা সচলে দেননি কখনো?
সচলে দিয়েছিলাম, অনেকদিন আগে। আসলে পুরোনো অনেক লেখাই এখানে তুলে রাখছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। আর আপনি যেহেতু কাতারে ছিলেন কয়েকদিন, আপনার অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে লিখুন না !
উত্তরমুছুন