পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২০ অক্টোবর, ২০১০

কী কারণ অনুভবে?

কেন প্রেমিকার দিকে তাকিয়ে প্রেমিকের মনে হয়ঃ এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে’? কেনই বা আমাদের জেগে ওঠে হৃদয়ে আবেগ’? কেন আম খেতে মিষ্টি লাগে? কেন মানুষ সঙ্গমে তৃপ্ত আর প্রত্যাখ্যানে ক্ষুব্ধ হয়? মানুষ কেন রেগে যায়? মানুষের সৌন্দর্যের, ভালো লাগার, ব্যথার, বেদনার, সুখের, ভয়ের- এইসব নানান অনুভূতিগুলোর উৎস আসলে কোথায়? 
 
আমরা সবাই আমাদের চারপাশের জগতকে দেখি, তার ঘ্রাণ শুঁকি, তার আওয়াজ শুনি, তাকে স্পর্শ করে ধন্য হই আর আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যেমনটা করেছেন হুমায়ুন আজাদ আমার ইন্দ্রিয়গুলিলিখে। আমরা ভাবতে ভালবাসি- আমাদের মানস পটে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিশ্বের যে ছবি আঁকা আছে সেটাই সত্যিকারের বাস্তব জগত।
আদৌ কি তাই?


মানসিক রোগিরা কিন্তু বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে অন্যভাবে, তারা এমন কিছু দেখে ভয় পায় যা হয়ত আমাদের কাছে হাস্যকর, আবার তারা এমন কিছু থেকে আনন্দ পায় যা হয়ত আদতে ভয়ংকর কোনো ব্যাপার। আমরা সুস্থরা মানসিকভাবে অসুস্থদের এইসব ভাবনাকে বলি অবাস্তব কল্পনা কিংবা হেলুসিনেশন, যার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। মানসিকভাবে একজন সুস্থ ও একজন অসুস্থ মানুষের মধ্যে পার্থক্য মূলতঃ বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের অনুভূতির ভিন্নতায়। বাস্তবে জগত তো একটাই কিন্তু তাদের মনোজগত দুটি পুরোই আলাদা। 

আরেকটা পার্থক্য আমরা করি - আমরা ধরেই নেই যে বাস্তব জগত সম্পর্কে ওদের ধারণাটা ভুল, আমাদেরটা একদম সঠিক, বাস্তবে কোনো দেবী নেই, নিশীথিনী নেই, সুতরাং মিসির আলীর ভুল করার প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু আমাদের এই ধারণা কি সঠিক? না, বাস্তব জগত সম্পর্কে আমাদের ধারণা পুরো সঠিক নয়, বরং কিছুটা হলেও distorted [১]. আমরা যাকে বাস্তবতা বলি সেটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের মস্তিষ্কের তৈরি করা একটা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। আমরা সচেতন অবস্থায় যে অভিজ্ঞতাগুলো সঞ্চয় করি তাদের স্বরূপ নির্ভর করে মূলতঃ আমাদের স্নায়বিক প্রক্রিয়াগুলি কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে তার উপর, প্রকৃত দুনিয়ায় কি ঘটলো তার উপর নয়।

এর কারণটা কী? ডারউইনীয় ব্যাখ্যা মতে মস্তিষ্কের যে বিবর্তন ঘটেছে সেটা আসলে বাস্তব জগতকে সঠিকভাবে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য ঘটে নাই। মানুষের সব উপলব্ধির মূল লক্ষ্য ছিল টিকে থাকা। সুতরাং মস্তিষ্কের বিবর্তন ঘটেছে কেবল যে কোনো মূল্যে আমাদেরকে টিকিয়ে রাখাকে ত্বরান্বিত করতে।

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্য একটু বিশদ উদাহরণ দেই। 
 

বলা যায় নানান তরঙ্গের সমুদ্রের মধ্যে আমাদের বাস। কসমিক, গামা, রঞ্জন, অতিবেগুনী, অবলোহিত - কত ধরণের রশ্মি, বিভিন্ন তাদের তরঙ্গের দৈর্ঘ্য। সবচেয়ে কম তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কসমিক রশ্মির,  আর সবচেয়ে বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেতারের। অথচ উপরের ছবিতে আমাদের দৃষ্টির সীমানাটা দেখুন। কসমিক কিংবা বেতার - এদের কোনটিই আমরা দেখতে পাই না। আমরা শুধু সেইসব রশ্মি দেখি যাদের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কেবল ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে পড়ে। এই ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যেই আটকে আছে আমাদের রংধনুর সাতটি রং। এর বাইরে আমরা কিছু দেখি না। কেন? কারণ, আমাদের মস্তিষ্কের কাছে সেই দেখাটা অপ্রয়োজনীয়। কারণ, সেই দেখা কিংবা না দেখাটা আমাদের টিকে থাকায় বিশেষ কোনো সাহায্য করে না। তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণের যে সাগরে আমরা ডুবে আছি সেটা একটা বাস্তব সত্য, কিন্তু তা অনুভব করার কোনো প্রয়োজন আমাদের কখনো হয় নাই, তাই মস্তিষ্ক আমাদের সেটা দেখানোর দায়িত্বও কাধে তুলে নেয় নাই।
মস্তিষ্ক কী করে বুঝল যে '৪০০ থেকে ৭০০' এই রেঞ্জটাই উপকারী? উপরের ছবি দেখে বলুন তো, কোন রং টিকে কেন্দ্র করে অন্যান্য রংয়ের তরঙ্গরা গড়ে উঠেছে? ঠিক, সবুজ! (আমাদের মস্তিষ্ক 'সবুজ রং' জাতীয় এক ধরণের সংকেত সৃষ্টি করেছে যেটা আসলে ৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের মাঝামাঝি দৈর্ঘ্যের কোনো বিকিরণকেই নির্দেশ করে)।  এখন সবুজ কার রং? গাছের পাতার। এবার দুইয়ে দুইয়ে চার মেলান। প্রাণীজগতের টিকে থাকার পেছনে যে খাদ্যশৃংখল তার মূলে রয়েছে গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমেই সূর্যের আলোকশক্তি গ্লুকোজ নামের এক চিনি জাতীয় খাবারে রূপান্তরিত হয়। এই আশ্চর্যজনক কাজটা করতে পারে কেবল গাছ, তার পাতায় অবস্থিত ক্লোরোফিল নামের এক অসাধারণ অণুর সাহায্যে।  আর ক্লোরোফিলের গায়ে আলো পড়লে যে তরঙ্গের প্রতিফলন ঘটে সেটার দৈর্ঘ্য ঠিক ঐ ৪০০-৭০০ ন্যনোমিটারের মাঝামাঝি। সুতরাং এতে আর আশ্চর্য কি যে ক্লোরোফিল দেখতে সবুজ হবে! আবার বুঝতেই পারছেন, সবুজ রংয়ের যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য সেটা দেখা মস্তিষ্কের জন্য কেন এত জরুরী!

আবহাওয়া বদলের সাথে সাথে গাছের পাতা পর্যন্ত পৌছানো সূর্যের আলোর বিকিরণও বদলে যেতে পারে- আকাশে মেঘ থাকলে একরকম, না থাকলে আরেক রকম, ভোর বেলায় এক রকম, গোধূলিতে অন্য রকম। এই পরিবর্তনের সাথে সাথে কিন্তু গাছের পাতার রংও পরিবর্তিত হবার কথা (যেহেতু প্রতিফলিত তরঙ্গের দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হচ্ছে)। সেটা হলে আবার আমাদের সমস্যা, খাবার চিনতে মুশকিলে পড়ে যাবো। সুতরাং গাছের পাতাকে সবসময়ই সবুজ দেখাটা গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটা করা মানেই হচ্ছে কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আর যে সব বিকিরণ আছে তাদেরকেও সঠিকভাবে নির্ণয় করা ও আলাদা করা। যেহেতু সূর্যের ও আমাদের পারিপার্শ্বিক বিকিরণগুলির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশিরভাগই ৪০০-৭০০ এর মধ্যে, সুতরাং এদের মধ্যে পার্থক্যটা পরিষ্কার করা মস্তিষ্কের জন্য জরুরী। ফলাফল আমাদের দৃষ্টিসীমা কেবল সবুজ রংয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে তার একটু ছড়িয়ে যাওয়া এবং অন্যান্য রংয়ের আবির্ভাব। একইভাবে মস্তিষ্কের কোনো দায় পড়ে নাই কোনো কারণ ছাড়া কেবল বাস্তবে আছে বলে ৪০০-৭০০ এর বাইরের কাউকে রঙিন করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করার। এ কারণেই রঞ্জন রশ্মি সাধারণ আলোক রশ্মি থেকে অনেক শক্তিশালী হলেও সে যখন বুক ফুঁড়ে যায় আমরা তা বুঝতে পারি না। অথচ, প্রিয়ার গোলাপী গাল দেখে 'বুকে বাজে সুখের মত ব্যথা'!

একই ব্যাপার আমাদের শোনার ক্ষেত্রেও। বাদুড় বিশ হাজার হার্টজের বেশি তীক্ষ্ণ শব্দও শুনতে পায়, আমরা পাই না। কারণ বাদুড়ের টিকে থাকার জন্য এই শোনাটা মানুষের চেয়েও বেশি দরকার। জানেন নিশ্চয়ই, বাদুড় রাতে চলাফেরা করে শব্দ তরঙ্গের সাহায্যেই।
 
 
 
সুতরাং দেখা যাচ্ছে বিবর্তন আসলে বাস্তব জগতকে সঠিকভাবে রিপ্রেজেন্ট করার জন্য ঘটে না, যদিও আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির কাজ মূলতঃ বাস্তব জগতকে উপলব্ধি করা। মস্তিষ্ক নামের একটা গডফাদার মাঝখানে এসে ঢুকেছে যার মূল লক্ষ্য আমাদেরকে টিকিয়ে রাখতে সর্বোত্তম সহায়তা প্রদান করা। আর এই প্রক্রিয়ায় সে উপলব্ধি করেছে যে ৪০০-৭০০ ন্যানোমিটারের রশ্মি দেখলেই এবং ২০-২০০০০ হার্টজের শব্দ শুনলেই আমাদের সবচেয়ে বেশি লাভ এবং সেই অনুযায়ী সে আমাদের DNA কে সংকেত পাঠিয়েছে আর সেই সংকেত অনুযায়ীই গড়ে উঠেছে আমাদের চোখের গঠন, কানের কার্যপদ্ধতি।

 জীবনানন্দ তার 'বোধ' কবিতায় লিখেছিলেন- এখানে প্রাসঙ্গিক যে রাসায়নিক, তড়িৎ অনেক উপায়েই মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করা যায়, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের অনুভূতি ও উপলব্ধি ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটতে পারে। সহজ উদাহরণ হচ্ছে মাদকদ্রব্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যদের সরবরাহ করার জন্য রীতিমত গবেষণা করে এলএসডি নামের এক মাদক উদ্ভাবন করে সে দেশের বিজ্ঞানীরা যা নেয়ার সাথে সাথে সৈন্যরা যুদ্ধের ভয়াবহতা ভুলে হেলুসিনেশন বা দৃষ্টিভ্রমে ভুগত, মুহূর্তে দূর হয়ে যেত তাদের যত কষ্ট, ব্যথা, হতাশা কিংবা বিভীষিকার অনুভূতি, তার বদলে জায়গা করে নিত কোনো চরম সুখানুভূতি। হেলুসিনেশনের সময় মানুষ অবাস্তব শব্দ শুনে, কাল্পনিক দৃশ্য দেখতে পায় যাদের কোনোটাই বাস্তবে খাপ খায় না। স্বপ্নে মানুষ যা দেখে তার তো পুরোটাই কাল্পনিক, বাস্তব জগতে সেভাবে কিছু ঘটে না। আবার আগেই বলেছি, বাস্তবে যত শব্দ হয় তার সবটাই আমরা শুনতে পাই না, যত কিছু দেখার তার সব আমরা দেখি না। এই দুই পর্যবেক্ষণকে এক করলে দাঁড়ায়- বাস্তব জগত ঘটিত আমাদের অভিজ্ঞতাগুলি যত না বাস্তব তার চেয়ে বেশি নির্ভরশীল আমাদের মস্তিষ্কের গঠন ও এর আভ্যন্তরীণ রসায়নের উপর।

আলো অন্ধকারে যাই মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয় শান্তি নয় ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!

প্রশ্ন হলো- বাস্তব জগতের যে খন্ডিত অংশ আমাদের ইন্দ্রিয় যেমন চোখ, কান, ত্বক, ইত্যাদির মাধ্যমে মস্তিষ্কে পৌঁছায় তাদেরকে নিয়ে মস্তিষ্ক কী করে, কীভাবে আমাদের মনের মধ্যে নানান প্রকারের চাপল্য, বোধ কিংবা অনুভূতির জন্ম হয়।

বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সচেতন মনের একটা ধর্ম হচ্ছে অনুভূতি সম্পন্ন হওয়া এবং আমাদের মস্তিষ্ক কোনো ধরণের বাহ্যিক অনুঘটক ছাড়াই সেই অনুভূতির জন্ম দিতে পারে। এখন এটা প্রমাণিত যে মানসিক ব্যাপারগুলো আসলে স্নায়বিক কার্যক্রমের উপর নির্ভরশীল। আর একেকটা অনুভূতির জন্ম আমাদের স্নায়ু কোষগুলির কোনো বিশেষ রকমের সজ্জা, সংগঠন (arrangement / organization)  অন্তঃযোগাযোগের ফলে। স্নায়ু কোষগুলি যদিও আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের চালিকা শক্তি কিন্তু এদের বিশেষভাবে সংগঠিত হওয়াটা আবার নির্ভর করে আমাদের টিকে থাকার ও বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সেই সংগঠন কোনো সুফল বয়ে আনবে কিনা তার উপর। সবকিছুর মূলে আবার সেই আমাদের জিনের (gene) টিকে থাকা।

কেটে গেলে ব্যথার অনুভূতি হয়- এর মানে কিন্তু এই না যে ছুরির ডগায় ব্যথাটা আগে থেকে বসেছিল, পোঁচ লাগা মাত্র সেটা ট্রান্সফার হয়ে আমাদের চামড়ায় ঢুকেছে। আবার চিনির তৈরি খাবার খেতে মিষ্টি লাগে, তার মানে কিন্তু এই না যে চিনি অণুগুলির মধ্যে মিষ্টি ব্যাপারটা মিশে ছিল। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো ইতিহাসের নানান সময়ে বিশেষ স্নায়বিক সজ্জার ভেতর দিয়ে গেছে যাতে পরবর্তীকালে আমাদের মনে ভালো কিংবা মন্দ লাগার স্পন্দন জেগে উঠে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় প্রকাশমান ধর্ম (emergent property)ভালো লাগার ধর্মটা প্রকাশ হবে তখনই যখন সেটা আমাদের বংশবৃদ্ধি ও টিকে থাকায় সাহায্য করবে। যেমন, মিষ্টি লাগা, সাহসিকতা, স্নেহ, ভালোবাসা, ইত্যাদি। একই ভাবে, যা কিছু আমাদের জন্য ক্ষতিকর তাদের প্রকাশমান ধর্মে থাকবে খুব অস্বস্তিকর ও খারাপ অনুভূতি যেমন- তিতা, ভয়, ব্যথা, হতাশা, ঘৃণা, ইত্যাদি। সংক্ষেপে এই হচ্ছে আমাদের অনুভূতিগুলির জন্ম রহস্য।
অনুভূতি তাই আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে  বিশেষভাবে সজ্জিত প্রাসঙ্গিক স্নায়ুকোষগুলিরই একটা বিশেষ অনুরণন।  অনেকটা অর্কেস্ট্রার মত। একেক ধরণের অনুভূতির জন্য যেন একেক ধরণের অর্কেস্ট্রা। তবে এদের সবার সুদূরপ্রসারী কারণ একটাই - নিজের জিনটাকে টিকিয়ে রাখা। চিনি যেহেতু শক্তির উৎস, সুতরাং এর স্বাদ মিষ্টি। আবার অতিরিক্ত ঠাণ্ডা কিংবা গরম তাপমাত্রা আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর, তাই এদের সংস্পর্শে আমাদের খারাপ লাগে।

কিন্তু এই খারাপ লাগাটা নিতান্তই একটা নিজস্ব ধারণা। চৈত্রের দাবদাহে কিংবা মাঘের শিরশিরে বাতাসের গায়ে সেটা লেপ্টে থাকে না। বাস্তবে তাপমাত্রা ব্যাপারটা তো কেবল অণু-পরমাণুর কম কিংবা বেশি কাঁপা কাঁপি - এর বেশি কিছু নয়। তেমনি, বর্জ্য পদার্থের দুর্গন্ধে আমাদের দম বন্ধকর অনুভূতি হয়। অথচ অণু-পরমাণুর জগতে গন্ধ বলেই কিছু নেই। জগতের রূপ, রস, গন্ধ সব শুধু আমাদের আপন আপন মস্তিষ্কের মধ্যে লুকানো।

যে সব ঐতিহাসিক প্রাকৃতিক ঘটনাবলীকে এক করে একসময় আমাদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের সজ্জাকে বাজে গন্ধের ফ্রেমে ফেলেছিল সেগুলো ছিল আমাদের অস্তিত্ত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। যেমন, পচা ডিম আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর তাই পচা ডিমের গন্ধ খুবই বাজে একটা অনুভূতি। আবার আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে এই চিনির বড় উৎস ছিল পাকা ফল, যে কারণে তাদের মধ্যে যারা চিনির স্বাদটাকে পছন্দ করত তারা পাকা ফল খেত বেশি, তারা পুষ্টিও পেত বেশি। সুতরাং টিকে থাকার উপায় হিসেবে বেশি পুষ্টি পেতে আমরা যাতে পাকা ফল বেশি বেশি খাই সেটা নিশ্চিত করতেই পাকা ফলের স্বাদ হয়ে গেল মিষ্টি!

একই ভাবে, বিপরীত লিঙ্গের দেহের ও মুখের গড়ন আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে নিজ নিজ বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই থেকেই আমাদের সৌন্দর্যের অনুভূতির সৃষ্টি। আমাদের পূর্বপুরুষদের মস্তিষ্ক এটা পর্যবেক্ষণ করেছে যে কিছু কিছু বিশেষ দৈহিক গড়নের ও মুখাবয়ব সম্পন্ন যৌন সাথী থাকলে নিজের ভবিষ্যতপ্রজন্ম কিছু বিশেষ সুবিধা নিয়ে জন্মায়, সেই সুবিধাগুলো তাদেরকে অন্যদের সাথে টিকে থাকার সংগ্রামে অতিরিক্ত সাহায্য করে। অতীতের এই পর্যবেক্ষণের ফলশ্রুতিই হচ্ছে আমাদের সৌন্দর্যবোধ। যদিও কবিরা ভিন্ন মত পোষণ করতে পারেন, কিন্তু এটাই আমাদের সৌন্দর্যের যে অনুভূতি তার ডারউইনের 'প্রাকৃতিক নির্বাচন' ভিত্তিক ব্যাখ্যার মূল কথা।

সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়া, ইন্দোনেশিয়া - এইসব গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশের মানুষের নাক একটু বোঁচা ও মোটা। আবার ককেশিয়ানদের দেখবেন সরু ও তীক্ষ্ণ উল্লম্ব নাক। নাকের এই ব্যাপারটা এসেছে বিবর্তনের কারণে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহওয়ায় বাতাসে এমনিতেই জলীয়বাষ্প বেশি থাকে, তাই নিঃশ্বাসের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে নাকের তেমন ভূমিকার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে যেখানে আবহাওয়া ঠান্ডা ও শুষ্ক, সেখানে অপেক্ষাকৃত বড় নাকের প্রয়োজন যাতে সে নিঃশ্বাসের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। নাক মানুষের মুখায়বয়বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং আমাদের সৌন্দর্যের যে ধারণা তাতে এর একটা বড় ভূমিকা আছে। এখন, উপরে সৌন্দর্যের 'প্রাকৃতিক নির্বাচন' ভিত্তিক যে ব্যাখ্যার কথা উল্লেখ করেছি তার মতে মানুষ বংশবৃদ্ধির জন্য সেই রকম যৌনসাথীই খুঁজবে যার চেহারা কিংবা নাকের গঠন (কিংবা দেহ) হবে ঐ এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা এভারেজ। কারণ সেটাই প্রাকৃতিকভাবে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ এবং আমাদের মস্তিষ্ক তাকেই প্রমোট করবে। বুঝতেই পারছেন, সেই প্রমোট করাটাকেই আমরা নাম দিয়েছি সৌন্দর্য।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মানুষের সব অনুভূতির পেছনের জৈবিক কারণ হচ্ছে টিকে থাকা এবং টিকিয়ে রাখা (বংশবৃদ্ধি)। সেই হিসেবে দুনিয়ার তাবত কবি, শিল্পী কিংবা গুণীরা যে সৌন্দর্যের গুণকীর্তন করেন তা আর কিছুই নয়, বোধহয় আমাদের মস্তিষ্কের নেয়া কিছু সিদ্ধান্তেরই প্রশংসা!

বই কৃতজ্ঞতাঃ [১] ভিক্টর জনস্টনের 'Why We Feel', পারসিউস বুকস প্রকাশনা, কেম্ব্রিজ, ম্যাসাচুসেটস, ১৯৯৯।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন