পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১০

প্রত্যাখান

ফরিদার আত্মহত্যার খবরে আমার ঘুম ভাঙ্গে আজ ভোরে।

ফরিদা আর আমি একই পাড়ায় থাকি, সেই হিসেবে আমি ওকে চিনি ছোটোবেলা থেকেই। আমাদের বাড়ির সামনে উঁচু বড় রাস্তা, সেটা পাড় হয়ে আবার নেমে গেলেই কালামদের বাঁশঝাড়, মোস্তফাদের পুকুর, তার পরপরই ফরিদার বাপচাচার ভিটা। ওদের বাড়ির সামনে ঈদগা মাঠেই ওর সাথে আমার প্রথম পুতুল খেলা।

ফরিদা আমার বছর দুয়েকের ছোট হবে, মানে বেঁচে থাকলে সবসময় তাই হত। পুতুলখেলা ছেলেদের খেলা নয়- এটা জানার আগে ফরিদাই ছিল আমার খেলার সঙ্গী। এরপর আর কোনোদিন আমার ফরিদার সঙ্গে ঘর করা হয়নি।


মৃত্যুর খবর কোনো স্বাভাবিক ঘটনা না হলেও আমি উত্তেজনা বোধ করিনা। কেন যেন ফরিদার মৃত্যুসংবাদ আমার কাছে চাল-ডাল-নুন-তেল-সাবান-বাজার-সদাইয়ের মত স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। মনে মনে কয়েকবার আউরাই, ফরিদা মারা গেল, মারাই গেল...।

আমি আলোড়নহীন থাকি। কিংবা মুর্দার নাম ফরিদা বলে আমাকে আলোড়নহীন থাকতে হয়।
অথচ, আমাদের জীবনের অনেক দিন, মাস, এবং বছর আমি ফরিদাকে দেখেছি, ফরিদা দেখেছে আমাকে। প্রতিবেশি হিসেবে, সমবয়সী দুজন মানব মানবী, আড়ালে আবডালে, প্রকাশ্যে। স্কুলে পড়ার সময় ঘাটপাড়ার ছেলেরা ফরিদাকে বেশ জ্বালাতো, স্কুলে যেতে আসতে, ঘুরতে, দাওয়াত খেতে গেলে, কিংবা অর্ধগ্রাম অর্ধমফস্বল বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে বৈশাখি মেলায় বান্ধবীরা মিলে স্টল দিলে। একবার এক অপরিচিত ছেলেকে শুনেছিলাম ফরিদাকে শিস দিতে। তারপর ঘুষি মেরে কেবল একটা দাঁত ফেলে দিয়েছিলাম ওর কুমারপাড়ার অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে মোড়ে। তারপর থেকে একই পাড়ার ছেলে হিসেবে আমি দায়িত্ব নিয়ে ফরিদার দেখভাল করার করতাম।

ফরিদা আমাকে ভাই ডাকতো। আমি ওকে শুধুই ফরিদা।

সাইকেলে চড়ে টুংটাং বেল দিতে দিতে ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝেমাঝেই ওর সাথে আমার দেখা হতো, মুখটিপে হাসতো ও, ওর সহজ সম্মতি ছিল আমার দাদাগিরিতে। কখনো কখনো ডাকতো, ও সবুজ ভাই, হুমায়ুনের দোকান থাইক্যা একটা হিন্দি বই আইন্যা দাওনা, ঐযে গোবিন্দর 'শোলা অর শবনম'। স্থির সাইকেলের চাকায় অলিখিত অথচ বিপদজনক পাড়াত সম্পর্কের ভারসাম্য রাখতে রাখতে বলতাম, এক থাবড়া মাইরা তুমার হিন্দি সিনামা দেখা বাইর করবাম, যাও পড়তে বসো গিয়া।

সেই ফরিদা আজকে গলায় দড়ি দিয়েছে। এই ফরিদাকে আমি চিনি। একরোখা ফরিদা, বাষ্পতাড়িত ভাতের ঢাকনার মত আবেগে তিরতির কাঁপা ফরিদা।

স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গ্যাঞ্জি পড়েই ধীরস্থির ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হই। ফরিদার মৃত্যুতে এ বাড়ির কিছু আসে যায় না, কিন্তু যে কোনো মৃত্যুই বাতাসে একটা অশুভ আশংকার ছোঁয়াচে শিহরণ ছড়িয়ে দেয়, আমি আমার ঘর থেকে বাইরে এক পা ফেলতেই বুঝতে পারি তার আছর। ফরিদা এই বাড়ির কেউ নয়, ফরিদা মরে গেছে, কিন্তু কেন যেন বাড়ির অন্য সবাই আড়ষ্ট হয়ে থাকে ফরিদার নামে।

ফরিদার মৃত্যু আমাকে বিচলিত করে নি, ফরিদার এই অহেতুক চলে যাওয়ায় আমার কিছু আসে যায় না- এই ধারণা যতক্ষণ পর্যন্ত না এই বাড়ির উঠোনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কলপাড়ে ছোটবোন আর ঘোষিঘরে মায়ের দুইজোড়া চোখ আমাকে সাপের মত নজড়ে রাখবে, আমি জানি। না, আমি এখনি কোথায়ো যাচ্ছি না- সেটা বোঝাতেই উঠোনের আমগাছটার একটা ডাল ভেঙ্গে দাঁত দিয়ে কামড়াতে থাকি। তারপর হেটে কলপাড়ের দিকে যাই, আমি নড়লে তাদের চোখলাগানো গ্রীবাও নড়ে, চলছে মাপঝোক, যেন অনেক দূর থেকে কেউ মাপছে আবহাওয়ার পারদ।

কোনো এক সময় আমাকেও ফরিদার মনে ধরেছিল, ভালো লেগেছিল, এরকম কিছু একটা ও বলেওছিল একদিন। তারপর অনেকদিন ফরিদার সাথে আমার কোনো কথা হয়নি। আমিই বলিনি। আমিও কী পছন্দ করতাম ফরিদাকে? ভালোবাসতাম ওকে? প্রতি বর্ষার প্রথম বাতাসে এতদিনের ঘরকুণো মানুষ যে দ্বিধায় ভোগে, যাবো কি যাবো না, আমি সেরকম ভুগতাম। বৃষ্টি সবারই ভালো লাগে, ভালো লাগে না শুধু বৃষ্টি শেষে জমে থাকা কাদা।

আমার অবহেলা কিংবা আসন্ন যৌবনের ভারেই হয়ত একসময় ফরিদার মধ্যে পরিবর্তন আসে। অনেক দিন পর, এক বৃষ্টিধোয়া দুপুরের পিচ্ছিল রাস্তায় ফরিদাকে আমি আবিষ্কার করি এক মায়াময় স্নিগ্ধতায় ভরা কচুরিলতার সৌম্য ঔদার্য্যের আধার হিসেবে। দেখি ফরিদা, একসময় পুতুল খেলতে গিয়ে আমাকে যার স্বামী হতে হয়েছিল, বড় হয়ে গেছে।

মাকে ফরিদার কথা বলি। একবার, সেইবারই শেষবার। তারপর ফরিদা কোনো এক জাদুবলে এ বাড়িতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আমি কোনো ঘোষণা শুনি না, কেবল টের পাই। সেই প্রথম আমার অক্ষমতা আঙ্গুল তুলে আমাকে শাসিয়ে ভয় দেখিয়ে আমার উপর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয়।

ফরিদাও কি টের পেয়েছিল? তবে সে তখন নারীত্বের দুয়ারে, তাই একসময় ঠিকই আমি ও ফরিদা আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে উঠি। ফরিদা তার ক্যামিষ্ট্রি নোট ফটোকপি করে এনে দিতে বলে, এনে দেই। ফরিদার মা মুরগি জবাই করতে ডাকলে যাই, কলেজ থেকে ফিরে গাগোসল সেরে পাশে বসা আমার মায়ের ফরিদা বিষয়ক কুটনামি অগ্রাহ্য করতে করতে ওর মায়ের পাঠানো মুরগির ঝোল দিয়ে ভাত খাই। আমার মায়ের ভান্ডারে ফরিদার দুর্নামের শেষ নেই। জ্বিনে ধরা থেকে শুরু করে ফাতরা-বেয়াদ্দপ-সোমত্থা কোনোকিছুই বাদ যায় না। সবই ফরিদার কাছ থেকে আমাকে একশহাত দুরে রাখার জন্য, ভাতের দলা মুখে দিতে দিতে ভাবি, মায়েরা এমন কেন হয়, কোনো মায়ের মনেই পড়শির মেয়ে কখনোই মানানসই হয়ে উঠে না।

তারপরও, প্রেম করে বিয়ে করেছিল ফরিদা। না, আমাকে নয়, বশিরকে। বশিরদের বাড়িও এ পাড়াতেই, দশ মিনিটের পথ। বশিরের সাথে ফরিদার প্রেম- আমার কাছে এ জীবনের সবচেয়ে বড় বিষ্ময়। মানুষ জীবনে কিছু না পেলে তার স্বপ্ন নিয়েই হয়ত বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু ফরিদাকে পাওয়ার তো কিছু নেই, তাহলে ফরিদা যেদিন বশিরের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল সেদিন কেন আমি ইচ্ছে করেই বাড়ির বাইরে রাত কাটাই, কেন তাহলে মনে হয় কেউ যেন আমার হৃৎপিন্ডকে একটা ধারালো চাকু দিয়ে ফালি ফালি করে কেটে দিয়েছে, কেন ফরিদাকে ঘৃণা করতে সাধ জাগে মনে? হ্যা, ফরিদা বশিরের সাথে চলে যাবার আগে আমার কাছে এসেছিল, আমাকে জানাতে। তোমাকে প্রত্যাখান করলাম- এই অহংকারটুকু ফরিদা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেদিন।

বশির ছেলে হিসেবে খারাপ ছিল না। টেনেটুনে বিএ পাশ করে অটোমোবাইলের একটা দোকান দিয়েছিল, সেও বছর ছয়েক আগে। তার দুবছর পরই তো ওদের বিয়ে হলো। বিয়ে মানে আসলে সেরকম ঘটকালি করে মানুষ খাইয়ে বিয়ে নয়। ফরিদা পালিয়েছিল বশিরের সাথে, যদিও ফরিদার বাবা চাচারা রটিয়েছিল বশির তাদের মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়েছে। কে কাকে ভাগিয়েছিল, বশির ফরিদাকে, নাকি ফরিদা বশিরকে? দুই পরিবারে মিটমাট হয়ে যাওয়ায় সত্যটা আর জানা হয়নি। এতদিন পর কেন জানি মনে হচ্ছে জানা উচিত ছিল। ফরিদাকে জিজ্ঞেস করলে বলত নিশ্চই। ফরিদা আমার কাছে কিছুই লুকোত না। অন্তত বিয়ের আগ পর্যন্ত।

ছয় বছর আগে পালিয়ে গিয়ে ফরিদা ঐ দুইদিন কোথায় ছিল? হোটেলে? নাকি কোনো আত্মীয়ের বাড়ি? নাকি বশিরের কোনো বন্ধুর আস্তানায়? কেমন ছিল ফরিদার ঐ দুইদিন? ফরিদার মৃত্যুর চেয়ে সেই দুইদিনের অজ্ঞানতা আমাকে বেশি পীড়া দিতে থাকে।

দুই বছর আগে মটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মরে যাওয়া বশির ফরিদার মত মেয়েকে ভাগিয়ে বিয়ে করেছিল- অতটা সাহসী ছেলে বশির ছিল বলে মনে হয় না। গত দুটি বছর বিধবা ফরিদার জীবন আমাকে কখনো এই প্রশ্নের সামনে এনে দাড় করায় নি, আমি নিজের ভেতরে লুকিয়ে ছিলাম, ফরিদার স্বামীহীন জীবন আমার কাছে কোনো বিশেষ তাত্.পর্য নিয়ে হাজির হয় নি, ফরিদা বেঁচেছিল ওর জেদ নিয়ে, অহংকার নিয়ে। আমি খুশি ছিলাম ওকে সেই রাতে ওর পাওনা অহংকারটুকু ফিরিয়ে দিতে পেরে।

কিন্তু আজকে ফরিদা মারা যাবার পর এই প্রথম আমি একটা প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। সকাল সাতটার ঘাসের গায়ে লেগে থাকা আলসে শিশিরে পা ভিজিয়ে আম গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে কেবল ভাবতে থাকি, ভাবতেই থাকি। অবশেষে জীবনকে প্রত্যাখান করা ফরিদার মৃত্যু আমাকে একটি হঠাত্ অর্থহীন হয়ে যাওয়া খুঁতখুঁতে প্রশ্নের ঘূর্ণিপাকে আটকে রাখে।

তোমার আর কি চাই ফরিদা?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন