পৃষ্ঠাসমূহ

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০১০

রূপকথার পালক ও কয়েকটি গদ্যকবিতা

সময়কে ছেড়ে দিলে

একটি পরিবার। একটি মহল্লা। একটি শহর। দানা বেধে দিনাতিপাত। প্রজন্ম থেকে জন্মায় নতুন প্রজন্ম। কাঁধ বদল হয় জীবনের বোঝা। ঘুরে ফিরে আসে দ্বেষ, সংশয়, সহমর্মিতা। কোথায়ো জোট বাধে মানুষ, কোথায়ো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জটলা। যখন ভাঙ্গনের গান শুনে আসে বিচ্ছেদ, ফুলেরা কাঁদে, কাঁদে বসন্তের হাওয়া। চায়ের দোকানে ঘাঁটি গাড়ে অবেলার রোদ।
তোমাকে পাবার আকুলতা শহরের বাতাসে ডেকে আনে বারুদের গন্ধ, যুদ্ধে যেতে ঘর ছাড়ে কিছু মানুষ। দেয়ালের গায়ে জমে ধুলোর আস্তর। পাতাদের লাশ পড়ে থাকে রাস্তায়, শেকড়ের কাছে।

তবু তো, সময়কে ছেড়ে দিলে যুমনার জলও স্ফটিক হয়, তাতে জেগে উঠে চর। পাখিরা ফিরে আসে বন্ধুর মত। কোনো কোনো দুরন্ত কৈশর পেরিয়ে আসে যৌবন, যোদ্ধাদের দল ফিরে আসে, ঘরে। পিতার কোল জুড়ে ঘুমন্ত শিশুটির মুখে খেলা করে লাস্যময় হাসি। পরিবার যুথবদ্ধ হয়, গলির মুখে অবিরাম ছুটে চলে ক্যারামের গুটি। শহর, ফিরে আসে শহরে।


ঘর

প্রতিদিন বাইরের তাপমাত্রা আমাকে ঘরমুখি করে কেন সে প্রশ্ন থাক- তার চেয়ে ভাবতে বসি আমার অধুনা জীবন, পৃথিবীর প্রতিটা লোমকূপে কচ্ছপের মত এক একটা দীর্ঘশ্বাস লুকায়ে যে আজ ঘুমিয়ে পড়েছে পবিত্র শহরে, একদা যেখানে ছিল অরণ্যের ছায়া, শালবনের চাঁদ। অতএব, মায়ের গর্ভে লাথি দিতে দিতে বাড়ছে অনাগত দিন- তবু তোমাকে অভিবাদন।

ভাবছি, এই শহরে কোথায়ো আছি আমি। কোনো এক খাঁজে কম্প্রেসরের শো শো আওয়াজ শুষে নিচ্ছে ফাসির মঞ্চে ঝুলে থাকা আমার নিথর শার্টের ঘাম, চোখের বাষ্প, পায়ের পাতায় লেগে থাকা শেষ আর্দ্রতাটুকু। ভাবছি শহর, তোমারই মত শুধু নিঃসঙ্গ আমি, আমার ঘর। প্রতিদিনকার সুষম বিন্যাস তাই পড়ে থাক দূরপাল্লার বাসের সিটে, অফিসের জানলায়, ঝুলে থাক শুকানো কাপড়ের ক্লিপে। মানুষ নক্ষত্রের মত ঘরছাড়া নয় কেন সে প্রশ্ন আজ থাক।

রূপকথার পালক

যখন মানুষের তৃষ্ণায় বাসা বাধে অশুভ ছত্রাক, ধমনীতে বাড়ে অধৈর্যের কালো রক্ত, কিংবা উদরে জন্ম নেয় সেই চতুর চড়ুই, রাজকন্যার সোনালি চুল চুরি করে যে তুলে দেয় ডাইনীর হাতে, তখন মানুষ কি জানে তার পাপ ছুঁয়েছে রাক্ষসের ডানা? কিছু কিছু মানুষও কি চড়ুইয়ের ঠোঁট আর দানবের চোখ নিয়ে বেঁচে থাকে না এক একটা রূপকথার গল্পে! অথচ, আমরা কেবল ভুলে যাই সেই পালকের কথা।

রাক্ষসপুরীতে বন্দী দুঃখী রাজকন্যার চোখ বেয়ে নেমে আসা একটা অশ্রু একদিন মুক্তো হয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে ভিড়েছিল এক তুলসির ঘাটে। সেখানে একটা শুভ্র পালক পরম আদরে মুক্তোর গা থেকে মুছে দিয়েছিল সাগরের নোনা জল, নদীর আঠালো কাদা। সেই মুক্তো সেই নামগোত্রহীন পালকের কাছে বলেছিল দুঃখী রাজকন্যার গল্প, হয়ত সত্যিই গল্প কিংবা কেবল গল্পটাই সত্যি। কিন্তু শুভ্র পালক, বালকের স্বপ্নের মত বহু মেঘ পাড়ি দিয়ে, ভীষণ যুদ্ধে রাক্ষসদের ড্রাগনদের আর একচক্ষু দানবদেরকে পরাজিত করে অবশেষে একদিন ঠিকই রাজকন্যার জানলায় নোঙর করেছিল, তাকে উদ্ধার করবে বলে। কিন্তু হায়, সমস্ত রাক্ষসের ভ্রমরকৃষ্ণ হৃদয় ছিড়তে ছিড়তে আর ড্রাগনের উত্তাপে পুড়তে পুড়তে ক্লান্ত পালক কপালে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙ্গাবে কি করে, তখন তার সেই শক্তি কোথায়? বেচারা পলকা পালক অবশেষে বুকের রক্ত ঢেলে কালি বানিয়ে লিখে রেখেছিল তার ভালোবাসার কথা। এবং তারপর, দুনিয়ার তাবৎ ব্যর্থ বিষন্ন প্রেমিকের মত আত্মাহুতি দিয়েছিল রাজকন্যার শিয়রে।

অথচ রূপকথার রূপসী রাজকন্যা, বুঝতে পারেনি পালকের ভার, ঘুম ভেঙ্গে উঠে তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল পাশের ডাস্টবিনে।

লগ্নহীন মন্ত্র

জীবনের সাথে একই একই সংলাপে অগ্নি ঘিরে সাত পাক বিষন্ন সমারোহে হারিয়ে জাতপাত সমঝোতার আগ্রহে একটা বীজ বুনেছি এইখানে, এর পর হাতে নিয়ে বিষন্নতা বসে থাকি তুমুল স্বপ্ন দেখি, গগনে হরিষ বিষাদ লগনে মুদিয়া আখি তালপত্রে বাসা বাধি শকুনীর পায়। তারপর পায় পায় চন্ডি হাওয়ায় তামাই বসনে শোষনের রাহু গুনি শীতলক্ষ্যের পাড়ে।

এই হোক তব গ্রহনের কাল, শবদেহ জাগানিয়া মন্ত্রের ডাকিনী সকালে কপাল পুড়ে চিতার আগুনে নিয়তি করেছি দান।

1 টি মন্তব্য: