পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২০ অক্টোবর, ২০১০

কচ্ছপ দ্বীপ

এত ব্যস্ততা যাচ্ছিলো যে হাঁপ ছাড়ার সুযোগই পাচ্ছিলাম না। যখন সুযোগ মিললো তখন দেখি হাঁপ ছাড়ার সুবিধামতন কোনো জায়গা পাই না। এদিকে সিঙ্গাপুরে বৃষ্টিপাত একটু কমলে পর আবহাওয়াটাও ভালো হতে শুরু করেছে তা প্রায় সপ্তাহখানেক। মোটের উপর তাই কোথাও ঘুরে আসার ইচ্ছাটা মনে চাগার দিয়ে উঠলো।
ঠিক হলো রবিবারে কুসু আইল্যান্ডে গিয়ে সমুদ্রস্নান হবে।

অনেকদিন কোনো নড়াচড়া হয় নাই। নদী, সাগর, পর্বতমালা দূরে থাক বাড়ির পাশের ঝোপে বৈকালিক রোদের আড়ালে কি কি হয় তাও দেখার অবসর ছিল না। তাই ভাবলাম, এখন যখন ফুরসত মিলেছে তখন প্ল্যান প্রোগ্রাম করে আগানো যাক। কিন্তু গভীর রাত অবধি প্রোগ্রামের প্ল্যান করে আর চোরাই ওয়েবসাইটে আই এম লিজেন্ড দেখতে গিয়ে ছোট্ট ভজঘট লেগে গেলো। সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দেখি- আমরা অলরেডি বেহাইন্ড দ্য স্কেজুল।


কুসু আইল্যান্ডে যেতে হলে বোটে যেতে হবে। মেরিনা সাউথ পিয়ার থেকে সেই বোট ছাড়ে দুই ঘন্টা পরপর। বাসা থেকে ফেরিঘাটে যেতে লাগে প্রায় ঘন্টাখানেক। যখন ঘুম থেকে উঠেছি, ততক্ষণে সকাল ন'টার বোট ধরার আশা প্রায়দূর পরাহত। অতএব কি আর করা! বউকে বললাম, তোমার রেডি হবার সময় বাড়িয়ে আরো এক ঘন্টা করা হলো, আর আমি আরেকটু ঘুমাতে গেলাম। ঘন্টাখানেক পর ডেকে দিও।
এইসব করে টরে তবু দুজনে মিলে রওনা হওয়া গেল। বাসস্টপে গিয়ে দেখি আররে, এইখানেও একই জিনিস- আই এম লিজেন্ড। ভাবলাম ছবি তোলার পোজটা তাহলে উইল স্মিথের সাথে ট্রায়াল দিয়েই ঠিক করে নেই।

সে যাক, দুবার বাস বদলে, এট্টুসখানি সিঙ্গাপুরের প্রায় অর্ধেক ঘুরে মেরিনা-সাউথ ফেরিঘাটে পৌছুতেই দেখি এগারোটার বোট ছাড়ি ছাড়ি করছে। বোট কিংবা ফেরি কোনোটাই না বলে তারচেয়ে প্রাক যমুনা ব্রিজ আমলের ভুয়াপুর-টু-সিরাজগঞ্জ রুটগামী মিনি লঞ্চগুলার কোনো এক জ্ঞাতিভাই বলাই ভালো।
যাইহোক, টিকিট কেটে চড়ে বসতেই হেলতে দুলতে বোট হারবার ছেড়ে বের হতে লাগলো।

বোট হারবার ছেড়ে বেরুচ্ছে
বোট হারবার ছেড়ে বেরুচ্ছে

আমাদের যাত্রার সঙ্গী হলো গুটিকতক যুগল, একটি উত্তর ভারতীয় টুরিস্ট পরিবার এবং আরেকটি দক্ষিণ ভারতবংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরিয়ান পরিবার। শেষোক্ত পরিবারের দুই পুরুষ সদস্য আবার মাছ ধরার যাবতীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে এসেছে। বোট ছাড়তেই তারা বিয়ারের ক্যান খুলে বসে গেল ।

সাগর থেকে সিঙ্গাপুরের ভিউ
সাগর থেকে সিঙ্গাপুরের ভিউ

আস্তে আস্তে বোট কোস্ট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে
আস্তে আস্তে বোট কোস্ট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে

সাগর থেকে সাগরে
সাগর থেকে সাগরে

মেইন ল্যান্ড থেকে কুসু আইল্যান্ড বেশি দুরে নয়, মাত্রই পনেরো মিনিটের পথ। দেখতে দেখতে চলে এলাম কুসুতে। যে বোটে আমরা আসলাম সেই একই বোট এরপর যাবে পাশের আরেকটা দ্বীপ সেইন্ট জোন্সে। আমরা কুসুতেই নেমে পড়লাম।

কুসু আইল্যান্ডে পৌছে
কুসু আইল্যান্ডে পৌছে

চীনা ভাষায় 'কুসু' অর্থ 'কচ্ছপ দ্বীপ'। কিংবদন্তী আছে যে, একবার এক চীন দেশীয় এবং এক মালয় জেলে জাহাজডুবীতে মরণাপন্ন হলে বিশালকায় এক কচ্ছপ নিজেকে দ্বীপে রূপান্তরিত করে ওই দুই জেলের জীবন রক্ষা করে। সেই থেকে এই কুসু হয়ে আছে ব্যতক্রমী এক দ্বীপ। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এই দ্বীপে আসে। বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর- এই দুই মাস এখানে ওরশ জাতীয় কিছু একটার আয়োজন করা হয়, যাতে আশেপাশের অনেক দেশ থেকেই মানুষ আসে সামিল হতে।

তবে আমরা যে উদ্দেশ্যে এসেছিলাম, সেটার গোড়ায় বিশাল ভাটার টান লাগলো। পুরো দ্বীপে দু'দুটো বেশ ভালো বীচ থাকলেও সত্যি সত্যিই ভাটা থাকায় কোনোটাই সাতারের উপযোগী বলে পাওয়া গেল না। এইদিকে মাথার উপর তখন গণগণে রোদ। সাথে ফিশিং গীয়ারও নেই যে মাছ ধরতে বসে যাবো। মনটা একটু খারাপ হলেও চারদিকটা ঘুরে দেখতে লাগলাম।

কচ্ছপ দ্বীপে
কচ্ছপ দ্বীপে

প্রথমেই চোখে পড়লো 'ওইশিং পন্ড'। প্রচুর কচ্ছপভরা এই সিমেন্ট বাধানো ডোবাকে দোআ পূরণের জায়গা কেন বলা হয় তা বোঝা গেল না। তবে কচ্ছপরা অনেক দিন বাঁচে বলে অনেকেই এই বিশ্বাস নিয়ে এখানে আসে যে কচ্ছপকে ছুঁয়ে দিলে বৈষয়িক উন্নতি আর দীর্ঘজীবন পাওয়া যাবে। বেশ ভীড় লক্ষ্য করা গেল এখানে।

ওইশিং পন্ড: সচলায়তন কচ্ছপের চেয়ে দীর্ঘজীবি হোক
ওইশিং পন্ড

বিশালকায় কচ্ছপ, ব্যাসে প্রায় দু'ফুট তো হবেই
বিশালকায় কচ্ছপ, ব্যাসে প্রায় দু'ফুট তো হবেই

অনেকেই বলে যে রিকন্সট্রাকশনের আগে কুসু দেখতে ছিল অনেকটা কচ্ছপ আকৃতির। কচ্ছপের পিঠের মত একটা পাহাড় আছে এখানে। এরপর সেদিকেই গেলাম। পাহাড়টার গা বেয়ে সাপের মত উপরে উঠে গেছে ১৫২টা সিড়ি। সিড়ি বেয়ে একদম চূড়ায় উঠে দেখি পাশাপাশি তিনটা মাজার (মালয় ভাষায় মাজার বা পবিত্র সমাধিমন্দিরকে বলা হয় ক্রামাত)। স্যার স্ট্যামফোর্ড রেফলস যখন ১৯ শতকে আধুনিক সিঙ্গাপুরের পত্তন করেন তখন এখানে সৈয়দ আব্দুল রহমান নাম্নি এক ধর্মপ্রাণ মানুষ বাস করতেন। তিনটি ক্রামাতের একটা সেই সৈয়দ আব্দুল রহমানের, বাকি দুটো তার মা নানেক গালিব এবং বোন ফাতিমার স্মারক। পাহাড় চূড়ায় ক্রামাত, কিন্তু বেশ জমজমাট বলেই মনে হল। ভক্তরা এখানে এসে ধনসম্পদ, সন্তানসন্ততি, ভালো বিবাহ, উত্তম স্বাস্থ্য আর সম্প্রীতির জন্য প্রার্থনা করে। নিঃসন্তান দম্পতিরাও নাকি সন্তানের জন্য প্রার্থনা করে এখানেই। দাম দিয়ে ইচ্ছাপূরণ তাবিজ কিনে গাছের ডালে বেধে রেখে যায় সবাই।

ক্রামাত
ক্রামাত

গাছের ডালে বাধা মানতের কাপড়
গাছের ডালে বাধা মানতের কাপড়

পাহাড়ের চূড়ায় মুসলমানদের মাজার, আর সমতলে চায়নীজ মন্দির। গল্প প্রচলিত আছে যে, বেঁচে যাওয়া ওই দুই জেলেই নাকি কচ্ছপের উপর তুষ্ট হয়ে এই মাজার আর মন্দির স্থাপন করে। পাহাড় থেকে নেমে তাই মন্দিরটা ঘুরে দেখতে গেলাম। বেশ ভালোই। তবে ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। তাই বাইরেই পোজ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হলো।

কুসু আয়তনে খুব বেশি বড় কোনো দ্বীপ নয়। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই চতুর্দিকটা ঘুরে দেখা হয়ে গেল। সেন্টজোন্স যাবার পরের বোটটা আসতে তখনও ঘন্টাখানেক বাকি। সাতার কাটার অপশন যেহেতু কপালে নাই, তাই ভাবলাম, খানিকটা জিড়ানো যাক। সামনে আপাত শুকনো বীচ আর মাথার উপর চিড়ল পাতাময় গাছ রেখে মৃদুমন্দ হাওয়ায় জিড়ানোটা যে বেশ জম্পেশই হয়েছিলো তা আর বলতে!




অবশেষে সেন্টজোন্স যাবার বোট আসলো। এই দ্বীপগুলোতে যাতায়াতের জন্য ঘড়ি ধরে চলাচল করা এই বোটই ভরসা। একবার যদি দিনের শেষ বোটটা আপনাকে ফেলে চলে যায় তাহলে আর দেখতে হবে না। ঘাটের লোকজনেরও তাই গুনেগুনে যাত্রী পারাপার করতে দেখা গেল।

কুসু আইল্যান্ড থেকে সেন্টজোন্স যেতেও পনেরো মিনিটের বেশি লাগলো না।
সেন্টজোন্স আকারে কুসুর চেয়ে বড় একটা দ্বীপ। তবে বেশিরভাগটাই পাহাড়ি। আর যা ভেবেছিলাম তাই। এখানেও সাতার কাটা বন্ধ। অগত্যা, আবার সেই ট্র্যাকিং।

একটা তাবুতে এক সিঙ্গাপুরিয়ান মালে পরিবারকে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বেশ জমিয়ে বসতে দেখা গেল। বাবা-মার বয়স অনুমান করলে কে বলবে যে এদের সাত-আটটা আন্ডাবাচ্চা? শুধু এদেরই না, আমার মনে হয় সব মুসলমান মালেদেরই একই অবস্থা। পরিবার-পরিকল্পনা বলে যে একটা কনসেপ্ট এই জগতে আছে তা বোধহয় তারা জানে না। একেকটা পরিবারও হয় মাশাল্লা।

যাই হোক,সেন্টজোন্সে কুসুর মতই কোনো জনবসতি নেই, কিন্তু ক্যাম্পিংয়ের প্রচুর ব্যবস্থা দেখা গেল। কয়েকটা বাংলোও আছে দেখলাম রাতে থাকার জন্য। সকাল থেকে আসা লোকজনের কেউ কেউ ভাটায় খালি হয়ে যাওয়া এংকেল হাইট পানিওয়ালা তীরে কোরাল, হারমিট ক্র্যাব, সী কিউকাম্বারসহ নানান রকম ছোটো ছোটো সামুদ্রিক প্রাণী আর কাকড়া দেখছে। তীর ঘেষে কিছু ম্যানগ্রোভও দেখা গেল। এক সময় কুসুর চাইতে সেন্টজোন্সকেই মনে হলো বেশি সুন্দর।

পাহাড়ের গা ঘেষে চলতে বেশ ভালোই লাগছিলো। তবে হাতে সময় বেশি না থাকায় আর আকাশে মেঘের হঠাত্ খাইয়ালামু-ভিজায়লামু গর্জন শুনে ঘুরাঘুরি সংক্ষিপ্ত করতে হলো।

অবশেষে ফেরার শেষবোটটাও চলে আসলো এবং আবার আমাদেরকে গুনে গুনে বোটে তোলা হল। ততক্ষণে দেহমন সারাদিনের একটা প্যাকেজ ট্র্যাকিং ট্যুর শেষে বাড়ি ফিরে একটা সুপারকুল শাওয়ার নিতে বড্ড উচাটন হয়ে উঠেছে।

 দ্বীপ ছেড়ে যাচ্ছি যখন

দ্বীপ ছেড়ে যাচ্ছি যখন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন