পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২১ অক্টোবর, ২০১০

ঈশ্বরের প্রকৃতি

ঈশ্বরের পৃথিবী হচ্ছে 'ফ্ল্যাট ওয়ার্ল্ড' - পুরাই সমতল পৃথিবী, এর উপর সবাই সমান, অন্তত সে রকমই শেখানো হয়েছে আমাদের। ঈশ্বরই নাকি সবকিছুর নিয়ন্তা। তাহলে তিনি নিশ্চই চাইবেন সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলুক। কিন্তু জগতে কত কিছুই না আছে - অস্বাভাবিক, অকল্পনীয়, ক্রুঢ়। কেন জগতের সবাই একই প্রিভিলেজ নিয়ে জন্মায় না? কেন কেউ কেউ সুস্থ হয়ে জন্মাবে আবার কেউ জন্মান্ধ হবে? কার দোষে কোনো কোনো হতভাগ্য মানুষ কখনই জানতে পারবে না - শিশুর হাসি কতটা নির্মল, আকাশ কতটা নীল, জোছনা কতটা মায়াময়, কতটা সুন্দর প্রেমিকার গালের ছোট্ট তিল! কেন নিজের সৃষ্টিকে ঈশ্বর জন্মান্ধ করে জগতে পাঠাবেন? কেন নিষ্পাপ শিশুকে বঞ্চিত করবেন স্নেহ-মায়া-মমতা থেকে? কেন তাকে ভোগাবেন রোগে-শোকে-তাপে?

এই সব ভাবায়।
আমি নিয়ত ব্যাখ্যা খুঁজে বেড়াই। একটা যুক্তি চাই, কিংবা নিদেনপক্ষে একটা সান্ত্বনা। একটা সময় মনে হয়েছিল, এমনও তো হতে পারে - হয়তো প্রতিটা আলাদা মানুষের রোগ-শোক-দৈন্যন্দিন কষ্টের মতন এতটা মাইক্রো লেভেলে তিনি নামেন না, ফালতু অযাচিত হস্তক্ষেপ তাঁর পছন্দ নয়। জগতটা এত বড় আর এর ব্যাপ্তি এত বিশাল যে এতে ঘটমান ছোটখাটো সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলোকে নিজের মত করেই ঘটার ক্ষমতা দিয়েছেন ঈশ্বর। একে আমরা বলি প্রকৃতির খেয়াল। হয়ত ব্যতিক্রম না রাখলে স্বাভাবিক ব্যাপারটাই ব্রাত্য হয়, খুঁত না থাকলে হয়ত সবকিছু একঘেয়ে লাগে, হয়ত সবাইকে সুখী করলে জগতের কোনো ভারসাম্য নষ্ট হয়। হয়ত ঈশ্বর তা করতে পারেন না সামগ্রিক ভালোর জন্যই।

ব্যাপারটা অনেকটা আইজ্যাক আসিমভের ফাউন্ডেশন ট্রিলজিতে বর্ণিত সাইকোহিস্ট্রির একটা অনুমিতির মত। উপন্যাসের মহান হ্যারি সেলডন যিনি কিনা গ্যালাক্সির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মনোবিদ এবং সাইকোহিস্ট্রির জনক, যিনি তার আবিস্কৃত বিজ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের প্রায় এক হাজার বছরের ভবিষ্যতকে একটি নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করতে পারেন। আসিমভের ভাষায়, এই সাইকোহিস্ট্রি বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যা ইতিহাস ও বর্তমানের গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যত গণনা করতে পারে। কিন্তু কয়েকটা অনুমিতি মেনে চললেই কেবল তা সম্ভব। তার প্রথমটি হচ্ছে, গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণের জন্য যে স্যাম্পল নেয়া হবে সেটা হতে হবে অনেক বড়। মাত্র একজন বা গুটিকয় মানুষকে বিশ্লেষণ করে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যতকে দাড় করানো যায় না। দ্বিতীয় অনুমিতিটা হলো, সাইকোহিস্ট্রি যে ভবিষ্যতকে অনুমান করবে তা আগেভাগে প্রকাশ করা যাবে না। সেটা প্রকাশিত হলে অযাচিত কিংবা অস্বাভাবিক কিছু চলকের আবির্ভাব ঘটতে পারে, কেউ কেউ ভবিষ্যতকে পালটে দেবার চেষ্টা চালাতে পারে এবং এর ফলে প্রকৃত ভবিষ্যতের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে।

ঈশ্বরের ধারণাটা কি মহান হ্যারি সেলডনের চরিত্রের মত কিছু? যিনি আগামীকাল কি হবে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, কিন্তু পুরো গ্যালাক্সির হাজার বছরের সম্মিলিত ভবিষ্যতের দিক প্রয়োজনে বদলে দিতে পারেন। সেটা তাঁকে পারতেই হবে, তা না হলে তিনি ঈশ্বর হবেন কীভাবে?

কল্পবিজ্ঞানের কাছ থেকে ধার করে হলেও আমি খুশি যে ঈশ্বরের খামখেয়ালিকে এরকম দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা যায়। মনে হয়, যদি ঈশ্বর বলে কোনো ধারণা কিংবা কেউ থাকে তাহলে তিনি হয়তো ততটা নিষ্ঠুর নন। অনন্ত নক্ষত্রবীথির তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপারগুলো তিনি ছেড়ে দিয়েছেন প্রকৃতির উপরে।

কিন্তু এই পর্যায়ে এসে অবধারিতভাবে এই প্রশ্নটি এসে যায়, ঈশ্বরের না হয় জগতের তুচ্ছ ব্যাপারে কোনো মাথাব্যথা নেই, কিন্তু জগতের অন্য সেই মহান, বৃহৎ ব্যাপারগুলো আসলে কি যা নিয়ন্ত্রণ করে ঈশ্বর নামের কোনো সর্বময় সত্ত্বা? খোদার যে কুদরত, ভগবানের যে লীলা, ঈশ্বরের যে মহিমা – তার ভিত্তিমূলে আসলে কার বসতি?

সুখ নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে হলো, যদি এবসোলিউট সুখ বলে কিছু থাকে তাহলে তার অধিকারি হবার একজন শক্ত ক্যান্ডিডেট হতে পারেন ঈশ্বর নিজে। ঈশ্বর কী সুখী? তাঁর সব আছে, বলা হয়ে থাকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি তিনি, সর্ব জ্ঞানী। সুখের সন্ধানও নিশ্চয়ই তার জানা আছে।

এই জায়গাটায় একটা ‘কিন্তু’ আছে বোধহয়। ততটা সুখী বোধহয় ঈশ্বর হতে পারেন নি। একজন সুখী ঈশ্বর কেন এমন একটা জগত তৈরি করবেন যেখানে এত কষ্ট, এত ক্লান্তি, এত জরা, এত ভেদ, এত ক্রোধ, এত জিঘাংসা, এত অসহিষ্ণুতা!

বলা হয়, স্বমহিমায় ভাস্বর ঈশ্বরের মনের বাসনা থেকেই এই জগতের উদ্ভব। সেই বাসনা হলো নিজের অস্তিত্ব কে নিজের বাইরে গিয়ে দেখা - to experience itself from outside. গুরু নানক ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন এর – বুদ্বুদ যেমন জলের ভেতর থেকে ভেসে উঠে, তেমনি আমরাও ভেসে উঠি খোদার consciousness থেকে। তিনি বললেন, হও। হয়ে গেল। কিন্তু তিনি যদি এতই স্বয়ং-সম্পূর্ণ হবেন তাহলে তার এই 'বড়ই সৌন্দর্য' টাইপ জগত তৈরি করে তারপর সেই জগতের সুন্দর ফল, সুন্দর ফুল, মিঠা নদীর পানির মধ্যে নিজেকে খোঁজার মাহাত্ম্যই বা কী?

আমাদের ঈশ্বর কি তাহলে অসুখী? ঈশ্বর কি নিঃসঙ্গ?

হয়তো জগতের যে মহত্তম উদ্দেশ্য সেটা কেবল ক্রমাগত নিঃসঙ্গ হতে থাকা কোনো এক ঈশ্বরের সুখী হবার প্রাণান্ত চেষ্টা। যে চেষ্টাকে সফল করতে গিয়ে তার চোখে পৃথিবীর আর সব নগণ্য বিষয়গুলো ধরা পড়ে না। তাতে কী! চূড়ান্তরকম বোরড একজন ভগবানকে যে কোন মূল্যে চীয়ার আপ করতে গিয়ে আমরা মানে তার সৃষ্টিজগতের সবাই না হয় 'গুরুত্বহীন' কিছু কষ্ট সহ্য করলামই। সবার সৃষ্টিকর্তা হিসেবে এতটুকু দাবি তিনি করতেই পারেন। যে বৃহত্তম উদ্দেশ্য পূরণের পথে আমরা সবাই ধীরে ধীরে এগুচ্ছি তার বিশালতার কাছে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়াগুলো ধুলিকণাবৎ। অন্যদিকে, ঈশ্বর মহান। তাই তার কি এত নিচে নামা সাজে? সাজে না। বরং না হয় আমরাই স্বীকার করে নেই কিছুটা ত্যাগ।

সুতরাং আমরা সবকিছু তাঁর হাতে সঁপে দেই। আর বলি, যাই করেন ঈশ্বর, করেন সবার মঙ্গলের জন্যে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন